এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড গুরুতর অনিয়ম ও আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবার হার্ডলাইনে। মুলত কোম্পানিটির বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি হলো, তারা ছয়টি মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ অবৈধভাবে বিনিয়োগ করে আত্মসাৎ করেছে এবং টাকা বিদেশে পাচার করেছে, যা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
এই গুরুতর অভিযোগের প্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) প্রতিষ্ঠানটির সামগ্রিক কার্যক্রমের ১৬টি সুনির্দিষ্ট বিষয় তদন্তের জন্য একটি তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটিকে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানিটির সার্বিক কার্যক্রম অনুসন্ধান করে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
মুলত এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিটির প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা (চিফ ইনভেস্টমেন্ট অফিসার) দায়িত্বে রয়েছেন রিয়াজ ইসলাম। আর কোম্পানিটির উপদেষ্টার হিসেবে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিশ্বসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক রেজাউর রহমান সোহাগ। সম্প্রতি বিএসইসির মার্কেট ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করা হয়েছে। তদন্তের বিষয়টি এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াজ ইসলামকে অবহিত করা হয়েছে। এছাড়া বিএসইসির সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন: বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক শেখ মো. লুৎফুল কবির, উপ-পরিচালক এস. এম. আহসানুল কবির এবং সহকারী পরিচালক মো. মতিউর রহমান। এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের পরিচালিত মিউচুয়াল ফান্ডগুলো হলো: ডিবিএইচ প্রথম মিউচুয়াল ফান্ড, গ্রিন ডেলটা মিউচুয়াল ফান্ড, এআইবিএল প্রথম ইসলামিক মিউচুয়াল ফান্ড, এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বিডি মিউচুয়াল ফান্ড ওয়ান, এনসিসিবিএল মিউচুয়াল ওয়ান এবং এমবিএল প্রথম মিউচুয়াল ফান্ড।
বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, গঠিত তদন্ত কমিটি এলআর গ্লোবালের ব্যবস্থাপনায় থাকা মিউচ্যুয়াল ফান্ডসমূহের নগদ ও নগদ সদৃশ সম্পদ এবং সিকিউরিটিজ বিক্রির অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার হয়েছে কি-না তা তদন্ত করে দেখবে। একইসঙ্গে ফান্ডগুলোর তহবিলের মেয়াদকালে কী পরিমাণ ভূয়া আয় হয়েছে এবং কোন সময়ে সেটা প্রতিবেদন করা হয়েছে তা নিরূপণ করবে।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো অতালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে তা খতিয়ে দেখবে। ফলে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের ছয়টি মিউচুয়াল ফান্ড এবং ভ্যানগার্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের একটি মিউচুয়াল ফান্ডের মোট ৫৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ ৩০ দিনের মধ্যে ফান্ডে ফেরত আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
এই বিনিয়োগ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত আনতে ব্যর্থ হলে ফান্ড দুটির সম্পদ ব্যবস্থাপকসহ সংশ্লিষ্টদের ওপর ৭০ কোটি টাকা জরিমানা আরোপ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। গত আগস্ট মাসে এ-সংক্রান্ত পৃথক আদেশ জারি করেছে বিএসইসি। কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
একটি আদেশে বিএসইসি জানিয়েছে, ২০১৯ সালে এলআর গ্লোবালের ব্যবস্থানাধীন ছয়টি মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ দিয়ে দুর্বল আর্থিক ভিত্তিসম্পন্ন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিটি ১০০ টাকা মূল্যের ইলিকুইড শেয়ার ১২ হাজার ৫০০ টাকায় কিনে মোট ৪৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। অথচ এই ফান্ডগুলোয় জনসাধারণের বিনিয়োগ রয়েছে, যা থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে দুর্বল আর্থিক ভিত্তিসম্পন্ন এ প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করায় বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে।
যদিও তদন্ত করে ২০২১ সালে ফান্ডগুলোয় বিনিয়োগের অর্থ ফেরত আনতে নির্দেশ দিয়েছিল তৎকালীন বিএসইসি। তবে এখনো বিনিয়োগের সেই অর্থ ফেরত আনা হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে ফান্ডগুলো বিনিয়োগকৃত ৪৯ কোটি টাকা ও বিগত দিনের সুদের অর্থ ৩০ দিনের মধ্যে ফেরত আনতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা যদি বিনিয়োগের অর্থ ফেরত আনতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ৬০ কোটি টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়েছে।
একই সঙ্গে জরিমানার অর্থ ৩০ দিন পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে কমিশনে জমা না দিলে প্রতিদিনের জন্য অতিরিক্ত আরও ১০ হাজার টাকা হারে জরিমানা ধার্য করা হয়। এতে বলা হয়, সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিটির সিইও ও প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলাম এ বিনিয়োগ ফেরত আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে সিইও রিয়াজ ইসলামকে গুনতে হবে ৫০ কোটি টাকা জরিমানা। শুধু সিইও রিয়াজ ইসলামই নন, এ ব্যর্থতার দায়ে সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান এলআর গ্লোবালকে ১ কোটি টাকা এবং এর তিন কর্মকর্তাকে আরও ৯ কোটি টাকা জরিমানা গুনতে হবে।
জানা গেছে, ২০২০ সালের জুলাই মাসে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ ঘটনায় মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ এনে বিডিনিউজের প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বিরুদ্ধে মামলা করে। এ মামলায় বিডিনিউজ এবং তৌফিক ইমরোজ ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ফ্রিজ’ বা অবরুদ্ধ রাখার আদেশ দেন আদালত। তবে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে দুদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয়।
এরপর অ্যাকাউন্টগুলো আবার খুলে দেওয়া হয়। অন্য এক আদেশে বলা হয়, ভ্যানগার্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টে ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ভ্যানগার্ড এএমএল বিডি ফাইন্যান্স মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ২০১৭ সালে দুর্বল আর্থিক ভিত্তিসম্পন্ন এএফসি হেলথ লিমিটেডে বিধিবহির্ভূত ৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। ওই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ায় সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠানটিকে সুদসহ ৯ কোটি টাকা ৩০ দিনের মধ্যে ফান্ডে জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হলো।
ওই সময়ের মধ্যে ফান্ডে অর্থ জমা করতে ব্যর্থ হলে সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠানটির ওপর ১০ কোটি টাকা জরিমানা আরোপ করা হয়েছে। জরিমানার অর্থ ৩০ দিন পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে কমিশনে জমা না দিলে প্রতিদিনের জন্য অতিরিক্ত আরও ১০ হাজার টাকা হারে জরিমানা ধার্য করা হয়।
অন্য আরেক আদেশে, ভ্যানগার্ড এএমএল বিডি ফাইন্যান্স মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগ যথাযথভাবে তদারকি ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ে ফান্ডটির ট্রাস্টি বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডকে (বিজিআইসি) ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আদেশ জারি হওয়ার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে এ জরিমানার অর্থ কমিশনে জমা দিতে বলা হয়েছে। অন্যথায় সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আদেশে জানানো হয়।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, এই অনুসন্ধান আদেশ এলআর গ্লোবালের কার্যক্রমে বড় ধরনের ধাক্কা দিতে পারে এবং দীর্ঘদিনের নানা গরমিল ও জবাবদিহিহীনতা উন্মোচনে সহায়ক হবে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় বিএসইসির এই পদক্ষেপকে তারা সময়োপযোগী বলে অভিহিত করেছেন।