ড. আবু তুরাব মুশতাক আহমাদ : ভূমিকা: মসজিদ আল্লাহর ঘর। মসজিদ ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র ও একটি পবিত্রতম স্থান। মসজিদ ছাড়া মুসলিম সমাজ কল্পনাও করা যায় না। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় মসজিদ একাধারে ইবাদাত-বন্দেগীর স্থান, সামাজিক ও ধর্মীয় মিলনায়তন, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, বিচার ও সম্প্রীতি লেন-দেনের মিডিয়া, নেতৃত্ব ও আনুগত্যের সূতিকাগার। মসজিদকে আদর্শ ইসলামী সমাজের হৃৎপিণ্ডও বলা যায়। আল্লাহ তা‘আলার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় স্থান মসজিদ। মদিনায় হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ স. এর ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো মসজিদ থেকে। রাসুলুল্লাহ স. এর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন পরবর্তী খলীফাগণ।
ইসলামের প্রথম যুগের মসজিদের দিকে আমরা যদি দৃষ্টিপাত করি, তাহলে দেখতে পাব, সেই সময়ের মসজিদ শুধু নামাযের ঘর ছিল না; বরং তাদের মসজিদ ছিল পরামর্শগৃহ, বিচারালয়, শিক্ষাকেন্দ্র, মজলুমের আশ্রয়স্থল, শিশুদের আনন্দধাম। রাসূলুল্লাহ স. এর মসজিদ ছিল সৌরজগতের সূর্যের মতো; সূর্যকে কেন্দ্র করে যেমন আবর্তিত হয় সকল গ্রহ-উপগ্রহ; তেমনি মুসলমানদের আধ্যাত্মিক, মানবিক ও সামাজিক সকল কর্মকাণ্ড আবর্তিত হতো মসজিদকে ঘিরে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, কালের পরিক্রমায়, বিশেষত বাংলাদেশে, মসজিদ হয়ে গেছে শুধুই নামাযের স্থান। মুসলমানদের চরিত্র গঠন, দীনি শিক্ষা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও মানবিক কর্মসূচীতে মসজিদের কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। কাজেই বাংলাদেশে মসজিদ ভিত্তিক সমাজ উন্নয়নে কী কী সমস্যা রয়েছে তা নির্দিষ্ট করা এবং সমস্যা সমাধানের উপায় বা করণীয় নির্ধারণ করার লক্ষ্যেই আজকের এ উপস্থাপনা।
মসজিদের পরিচয়
মসজিদের অর্থ ‘সাজদার স্থান’। ইসলামের পরিভাষায়- সালাতের জন্য ওয়াকফকৃত নির্দিষ্ট স্থানকে মসজিদ বলে। মসজিদকে ‘মহান আল্লাহর ঘর’ বলা হয়ে থাকে। সাজদাহ থেকে মসজিদ এর উৎপত্তি। গঠনরীতি অনুসারে শব্দটি মাসজাদ হওয়া দরকার ছিল কিন্তু এর ব্যাপকার্থের কারণে মাসজাদ না হয়ে মসজিদ হয়েছে। কেনান, মসজিদ শুধু সাজদার স্থান নয়। এতে সালাতসহ আরো বহু কাজ আঞ্জাম দিতে হয়। সেজন্য মসজিদ প্রথম দিন থেকেই আল্লাহর হক ও বান্দার হকের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর সর্বপ্রথম মসজিদ মক্কার ‘মাসজিদুল হারাম’ তথা বায়তুল্লাহ্। আর দ্বিতীয় প্রাচীনতম মসজিদ ফিলিস্তিনের ‘মাসজিদুল আকসা’।
সমাজ উন্নয়নের ধারনা
সমাজ উন্নয়ন বলতে একটি সমাজের সামগ্রিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনকে বোঝায়, যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার মান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন হয়। এটি সামাজিক অগ্রগতি অর্জনের একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যার লক্ষ্য হলো সমাজের মানুষের কল্যাণ সাধন করা এবং মানব সম্পদ বিকাশ করা।
কাজেই আদর্শ সমাজ হলো পারস্পরিক সুসসম্পর্ক, ভালোবাসা, ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীন সুষ্ঠুসুন্দর ও শান্তিময় সমাজব্যবস্থা। যেখানে থাকবে না অন্যায়, অবিচার, মিথ্যাচার, প্রতারণা, পরনিন্দা, সুদ-ঘুষ, দূর্নীতি, জুয়া, লটারি, মাদকাসক্তি, ধূমপান, অধিকারহরণ, চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, ছিনতাই, সন্ত্রাস, মারামারি, হানাহানি, হত্যা, আত্মহত্যা, যৌতুক, নারী নির্যাতনসহ নৈতিকতাবিরোধী সামাজিক অপরাধ।
রাসুলুল্লাহ স. ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকাণ্ড মসজিদ থেকে পরিচালনা করেছেন। কালের পরিক্রমায়, বিশেষত বাংলাদেশে, মসজিদ কেবল নামাজের স্থান হিসেবে বিবেচিত। মুসলমানদের চরিত্র গঠন, দ্বিনি শিক্ষা, আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও মানবিক কর্মসূচীতে মসজিদের কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। মসজিদ তার অতীত গৌরবে ফিরে এলে মসজিদই হতে পারে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের পরীক্ষিত উপাদান।
ইসলামে মসজিদের গুরুত্ব
মসজিদ পৃথিবীর আদি নিদর্শন। আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে সবার আগে মসজিদ সৃষ্টি করেছেন। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
اِنَّ اَوَّلَ بَیْتٍ وُّضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِیْ بِبَكَّةَ مُبٰرَكًا وَّ هُدًی لِّلْعٰلَمِیْنَۚ
নিশ্চয় প্রথম ঘর, যা মানুষের জন্য স্থাপন করা হয়েছে, তা মক্কায় অবস্থিত। যা বরকতময় ও হিদায়াত বিশ্ববাসীর জন্য। [সূরা আলে ইমরান, ৩ : ৯৬]
রসুলুল্লাহ সা. যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, মদিনার উপকণ্ঠে কুবা পল্লীতে তিনি সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদে কুবা ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মসজিদ হাওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। এরপর তিনি যখন মদিনা নগরীতে প্রবেশ করলেন, সাহাবিদের সঙ্গে নিয়ে তিনি মদিনার কেন্দ্রবিন্দুতে নির্মাণ করলেন মসজিদ। তখন মুহাজির সাহাবিদের কোনো ধনসম্পদ ছিল না। সকল সহায়-সম্পত্তি মক্কায় রেখে তারা এক কাপড়ে ঘর ছেড়েছিলেন। এই রকম সংকটময় মুহূর্তেও রাসূলুল্লাহ সা. মসজিদের জন্য জমি ক্রয় করে এর অবকাঠানো তৈরি করলেন। মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে রাসূল সা. শুধু আদেশ করেই ক্ষান্ত হননি, হাদীস ও ইতিহাস সাক্ষী, সাহাবিদের সাথে তিনি নিজ হাতে কাদামাটির ইট বানিয়েছেন, সেই ইট কাঁধে বহন করেছেন। এটিই প্রমাণ করে যে, রাসূল স. এর কাছে মসজিদের নির্মাণ কাজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি যে মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ, বারবার তার নজির স্থাপন করেছেন। শুধু তাই নয়, যারা মসজিদ নির্মাণ করে, তাদের জন্য সুসংবাদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
مَنْ بَنَى مَسْجِدًا لِلّٰهِ تَعَالَى- بَنَى اللّٰهُ لَهُ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ
যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য মসজিদ নির্মাণ করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ ঘর বানাবেন। [সহিহ মুসলিম-১০৭২ ইফা]
রাসুলুল্লাহ সা. আরো বলেছেন, যেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত শ্রেণির মানুষ আল্লাহর ছায়ায় আশ্রয় পাবে। সাত শ্রেণির এক শ্রেণি হলো ওই সকল মানুষ, যাদের হৃদয় সব সময় মসজিদের সাথে যুক্ত থাকে। [বুখারী-৬২৭ ইফা ও মুসলিম-২২৫২ ইফা]
সমাজ উন্নয়নে মসজিদের ভূমিকা
আদর্শ ও মানবিক সমাজ গঠনে মসজিদের ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসু, তার সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা আমরা রাসূল স. এর যুগের মসজিদে নববি থেকে পাই। সকল প্রকার ধর্মীয়, মানবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে এই মসজিদ থেকে। মসজিদভিত্তিক সমাজব্যস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে অগ্নিগহ্বরের কিনারায় অবস্থিত একটি জাতিকে রাসূল সা. সোনার মানুষে পরিণত করেছেন। নিম্নে মসজিদ ভিত্তিক গ্রাম ও সমাজ উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপগুলো উপস্থাপন করা হলো:
ক। একত্ববাদের চেতনা তৈরি:
মসজিদ তাওহিদের প্রতীক। মসজিদে রাসূলের তরিকায় এক আল্লাহর ইবাদত করা হয়। মসজিদের ইমাম-খতিব যদি বিজ্ঞ ও হকপন্থী আলেম হন এবং ওই সমাজ যদি মসজিদ দ্বারা পরিচালিত হয়, তবে মুসল্লিদের ভেতর থেকে আপনাআপনি শিরিক বা বহুত্ববাদী চেতনা দূর হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সা. জুমআর বয়ানে, সাধারণ আলোচনায়, ব্যক্তিগত নসিহতের মাধ্যমে বারবার শিরিকের ব্যাপারে মুসল্লিদেরকে সতর্ক করতেন। যার ফলে এক সময়ের মূর্তিপূজারী মানুষগুলো শিরিক বর্জন করে তাওহিদের রশিকে শক্ত করে আকড়ে ধরে। কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী একজন ইমাম যখন মসজিদে নববির আদলে তার মুসল্লিদেরকে তাওহিদের দীক্ষা দেন এবং শিরিকমুক্ত ঈমান গঠনের নাসিহাহ পেশ করেন, তখন সেই সমাজ খুব সহজেই তাওহিদি সমাজে পরিণত হয়।
খ। ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা:
ইসলাম যে কয়টি বিধানের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে, তারমধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মুসলমানদের পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ববোধ স্থাপন। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, প্রকৃত মুসলমান সে, যার হাত এবং মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। [সহিহ বুখারী-৯ ইফা] মসজিদভিত্তিক সমাজব্যবস্থা মুসলমানদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও সুসম্পর্ক তৈরিতে জোরালো ভূমিকা রাখে। জামাতে নামাযের কাতারে ইসলাম ধনী-গরিব, আমীর-ফকিরের কোনো বৈষম্য রাখেনি। ফলে প্রতিটি মানুষ তার পেশা, বংশ ও অর্থনৈতিক তারতম্য পেছনে ফেলে নামাযের কাতারে এক ও অভিন্ন মর্যাদার মানুষে পরিণত হয়। এতে সুদৃঢ় হয় পারস্পরিক সম্পর্ক এবং নির্মূল হয় উঁচু-নীচুর ভেদাভেদ। তাছাড়া নিয়মিত জামাতে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে প্রত্যেকে তার মুসলমান ভাইয়ের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে পারে। অসুস্থতা অথবা অন্য কোনো বিপদে কেউ নামাযে অনুপস্থিত থাকলে বাকিরা সহজেই তার খোঁজ-খবর এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে পারে। আবার সালাতের মাধ্যমে প্রতিদিন দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ায় সম্প্রীতি ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। এভাবে মসজিদভিত্তিক সমাজব্যবস্থা পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও ভালোবাসায় একটি জাতিকে একই সুতোয় গাঁথা একটি তসবিহতে পরিণত করে।
গ। নেতৃত্ব ও আনুগত্যের অনুশীলন:
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, যিনি নামাযের ইমাম তিনি সমাজেরও ইমাম। একজন ইমাম যখন মসজিদ পারিচালনা করেন, সালাতের নেতৃত্ব দেন, মুসল্লিদের নাসিহাহ করেন, তার মধ্যে সামাজিক নেতৃত্বের স্বতঃস্ফূর্ত যোগ্যতা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে সমাজের জন্য তিনি প্রোডাক্টিভ নেতায় পরিণত হন। আবার মুসল্লিবৃন্দ, যারা নামাযে ইমামের হুবহু অনুসরণ করেন, তাদের মধ্যে নেতাকে মান্য করার মানসিকতা এবং আনুগত্যের বোধ জাগ্রত হয়। ফলে সেই সমাজের মানুষেরা, মসজিদভিত্তিক জীবনব্যবস্থা অনুশীলনের কারণে, সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত হয়।
ঘ। জ্ঞানচর্চার সূতিকাগার:
রাসূলুল্লাহ স. এর যুগের মসজিদে নববি ছিল কুরআন ও হাদীস চর্চার কেন্দ্র। আসহাবে সুফফার কথা আমরা জানি। একদল দরিদ্র সাহাবি, ইলমচর্চার জন্য তারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের কোনো পেশা ছিল না। মসজিদে নববিতে পড়ে থাকতেন। কোনো খাবার হাদিয়া এলে খেতেন না এলে উপোস থাকতেন। তারা রাসূল স. এর মুখনিঃসৃত হাদীস সংরক্ষণ ও প্রচার করতেন। এছাড়া রাসূল স. যখনই সুযোগ পেতেন, মসজিদে এসে সাহাবিদেরকে কুরআন ও হাদীস শেখাতেন। মসজিদ যেন ইলমচর্চার মারকায হয়ে ওঠে, এ ব্যাপারে রাসূল সা. সাহাবিদেরকে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি মসজিদে ইলমচর্চার সুসংবাদ প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো সম্প্রদায় যখন আল্লাহর ঘরে একত্রিত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত ও পরস্পরে জ্ঞানচর্চা করে, তাদের ওপর শান্তি নাযিল হয়, আল্লাহর রহমত তাদেরকে পরিবেষ্টন করে এবং ফিরিশতারা তাদেরকে ঘিরে রাখেন; মহান আল্লাহ উপস্থিত ফিরিশতাদের কাছে জ্ঞানচর্চাকারীদের কথা আলোচনা করেন। [সহিহ মুসলিম-৬৬১০ ইফা]
মসজিদভিত্তিক মক্তব আমাদের সোনালি অতীত। মক্তব বাদ দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। অথচ অত্যন্ত সুকৌশলে এই অপূর্ব কুরআনিক শিক্ষাব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। মসজিদভিত্তিক দীনি জ্ঞানচর্চার ধারা জারি থাকলে মানুষেরা খুব সহজেই ইসলামের মৌলিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে পারে। আর কোনো সমাজে ইসলামী জ্ঞানে জ্ঞানবান মানুষের সংখ্যা যত বাড়ে, সেই সমাজ ততবেশি অপরাধ, দুর্নীতি, হত্যা, অশ্লীলতা, ধর্ষণ, যৌতুক ও মাদকমুক্ত সোনার সমাজে পরিণত হয়। অতীতের মক্তবভিত্তিক কুরআনিক শিক্ষাব্যবস্থা তার পরীক্ষিত উদাহরণ। এছাড়াও মসজিদভিত্তিক পাঠাগারের সংস্কৃতি চালু থাকলে মুসল্লিরা নামাযের পাশাপাশি কুরআন-হাদীসসহ জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধ হতে পারে। যে সমাজে মসজিদভিত্তিক জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতি যত জোরালো হবে, সেই সমাজ ততবেশি মানবিক, সুস্থ ও আদর্শ সমাজে রূপান্তরিত হবে।
ঙ। পারিবারিক সংকট নিরসন:
রাসূল স. সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন পরিবার-ব্যবস্থাকে। পারিবার রিলেটেড যত হাদীস আছে, অন্য কোনো বিষয়ে সম্ভবত এত হাদীস বর্ণিত হয়নি। কারণ পরিবার হলো সভ্যতার সূতিকাগার। পরিবার ধ্বংস হলে সভ্যতা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। রাসূল সা. মসজিদে বসে সাহাবিদের পারিবারিক সমস্যার সমাধান দিতেন। কখনো স্বামী-স্ত্রীকে উপস্থিত করে কাউন্সেলিং করতেন। একটি আদর্শ মসজিদের বৈশিষ্ট্য এটাও যে, সেখানে পারিবারিক সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। মসজিদ কর্তৃপক্ষের উচিত মসজিদে এমন ব্যবস্থা রাখা, যেন সমস্যাগ্রস্থ মানুষেরা সহজেই তাদের সমাধান পেয়ে যায়।
চ। পরামর্শগৃহ:
নামাযের পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ স. এর মসজিদ পরামর্শ সভার জন্য ব্যবহৃত হতো। হদ, জিহাদ, চুক্তি, কূটনৈতিক সম্পর্ক, পররাষ্ট্রনীতিসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো মসজিদে নববিতে, পরামর্শের ভিত্তিতে। সেই অর্থে মসজিদে নববি ছিল পরামর্শগৃহও। রাসূলের সা. পর খোলাফায়ে রাশেদার যুগেও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত মসজিদে নববিতে নেয়া হতো। একটি সুস্থ ও মানবিক সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে মসজিদভিত্তিক পরমর্শসভার বিকল্প নেই। পরামর্শের জন্য মসজিদের বরকত তো আছেই, পাশপাশি দায়িত্বশীলরা যখন পরামর্শ করতে মসজিদে একত্রিত হন, তখন কাজটার প্রতি তাদের গুরুত্ব বেড়ে যায় ও সম্ভ্রমবোধ জাগ্রত হয়।
ছ। মসজিদকেন্দ্রীক আইন ও বিচারব্যবস্থা:
সালাতের পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ স. এর মসজিদ সালিশ-বিচারের জন্যও ব্যবহৃত হতো। নববি যুগ, খোলাফায়ে রাশেদার যুগসহ ইসলামের সোনালি দিনের মুসলিম সমাজের বিচার ব্যবস্থা ছিল মসজিদকেন্দ্রীক। মসজিদভিত্তিক বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে রাসূল সা. সমাজ থেকে সকল প্রকার অপরাধের মূলোৎপাটন করেছিলেন। এখনো কোনো সমাজে যদি মসজিদভিত্তিক বিচারব্যবস্থার সংস্কৃতি চালু থাকে, তবে সেই সমাজ নববি আমলের সুফল পেতে পারে। মিথ্যা মামলা, মিথ্যা সাক্ষ্য, ঘুষ খেয়ে বিচারক কর্তৃক নিরপরাধকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার মতো জঘন্য পাপ ও অন্যায় চালু আছে দুনিয়া জুড়ে। যার কারণে মানুষ ইনসাফ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মসজিদভিত্তিক বিচারব্যবস্থা চালু থাকলে এই অপকর্ম রোধ করা সম্ভব। কারণ, মসজিদের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও ভীতি নেই, এমন মুসলমানের সংখ্যা খুবই কম। মসজিদে দাঁড়িয়ে ভুল বিচার বা মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করতে গেলে যে কেউই দশবার ভাববে। অতএব, মসজিদকেন্দ্রীক বিচারব্যবস্থা চালু হলে আখেরে জনগণেরই কল্যাণ হবে এবং এর মাধ্যমে নিশ্চিত হবে ইনসাফ।
জ। মসজিদের অর্থনৈতিক ভূমিকা:
সমাজ পরিবর্তনের জন্য মসজিদগুলোকে ধর্মীয় দায়িত্বের পাশাপাশি অর্থনীতির ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে হবে। মানুষের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-বেদনার ভাগিদার হতে হবে মসজিদ কর্তৃপক্ষকে। রাসূল স. যুদ্ধলব্ধ গনিমতের মালামাল বণ্টন করতেন মসজিদ প্রাঙ্গণে। আবার যাকাতের মাল গ্রহণ ও বিতরণ করতেন মসজিদে নববির ভেতর। মসজিদে শিক্ষাদান অথবা নাসিহাহ করার সময় কখনো রাসূল স. এর কাছে খাদ্যদ্রব্য হাদিয়া এলে রাসূল স. মসজিদে বসে সেই খাদ্যদ্রব্য সাহাবিদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন। মসজিদে কোনো ক্ষুধার্ত আগন্তুক এলে রাসূল স. তাকে বাড়িতে নিয়ে যেতেন অথবা কোনো সাহাবির বাড়িতে পাঠাতেন। জনগণের প্রতি যে মসজিদের এবং মসজিদ কর্তৃপক্ষের অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্বও আছে, তার প্রমাণ আমরা এসব ঘটনা থেকে পাই।
তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকদের কাছে ক্ষুধা এক রূঢ় সত্যের নাম। তীব্র ক্ষুধা ও অভাবের কারণে অনেক মানুষ ঈমান পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। গ্রামাঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত অসংখ্য মানুষ সালাত আদায় না করার পেছনে অভাবকে দায়ী করে। আবার অভাবের কারণে এদেশের পাহাড়ি ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অসংখ্য মানুষের খ্রিষ্টান হয়ে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনার নাম। রাসূল স. জানতেন যে দরিদ্রতা কখনো কখনো ঈমান নষ্ট করে দিতে পারে। এ জন্য তিনি দুআ করতেন, হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে কুফুরি ও ফকিরি থেকে পানাহ চাই।
বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে মসজিদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু করা খুবই জরুরি। মসজিদ কর্তৃপক্ষ চাইলে যাকাত-ফিতরা আদায় করে দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করতে পারে। আবার ফান্ড তৈরি করে অভাবীদের কাছে খাদ্যদ্রব্য ও চিকিৎসেবা পৌঁছতে পারে। স্বাবলম্বীকরণ, অভাব দূরীকরণ, বিনামূল্যে খাদ্যবণ্টন, চিকিৎসা সহায়তা প্রদান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মসজিদকে সম্পৃক্ত হতে হবে, যেভাবে সম্পৃক্ত ছিল রাসূল স. এর মসজিদ। তবেই মসজিদভিত্তিক সুস্থ ও মানবিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
মসজিদভিত্তিক সমাজ উন্নয়নে সমস্যা ও সম্ভাবনা
সমস্যা-১
আমাদের দেশের মসজিদগুলোতে দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা ছাড়া আর কোন সামাজিক প্রোগ্রাম, শিক্ষা প্রোগ্রাম, গ্রামীন সালিশ কেন্দ্র, সামাজিক নিরাপত্তা ও সমাজ সেবার কেন্দ্রবিন্দু কিছুই নেই।
সমাধান:
রাসূলুল্লাহ স., খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনকাল ইসলামের সোনালি যুগে মসজিদকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হতো এবং সামাজিক সালিস ও ন্যায় বিচার ইত্যাদি সামাজিক সমস্যার সমাধা হতো। সামাজিক বিচার-আচার, বিবাহ-শাদি, দারিদ্র্য বিমোচন, যাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ ইত্যাদি কার্যক্রম মসজিদকে ঘিরেই অনুষ্ঠিত হতো। রাষ্ট্রীয় ফরমান, সামাজিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ও সতর্কবার্তা, এমনকি কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণাও মসজিদের মিম্বার থেকে ঘোষিত হতো। বিধায় গ্রাম ও সমাজ উন্নয়নে মসজিদগুলোকে ইসলামের সোনালী যুগের মসজিদের ভূমিকায় পরিচালনা করা।
সমস্যা-২
অধিকাংশ মসজিদের সভাপতি কালো টাকার মালিক এবং মহাজনি সুদখোর ও ঘুষখোর ইত্যাদি। ৯৫ শতাংশ মসজিদ কমিটির সদস্যরা নামাজেই আসেনা, তাদের নামাজের ইমামতি করা এবং জুমার খোতবা দেওয়ারও কোন যোগ্যতা নেই। ফলে মসজিদের খতিব, ইমামগণ সুদ, ঘুষ, দূর্নীতির বিপক্ষে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে না।
সমাধান:
কারা মসজিদ পরিচালনা করতে পারবেন, তাদের যোগ্যতা কী হবে, তা ইসলাম নির্ধারন করে দিয়েছে। কাজেই সে নীতিমালার আলোকে মসজিদ কমিটি গঠন করতে হবে। মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্যদের যোগ্যতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّمَا یَعْمُرُ مَسٰجِدَ اللّٰهِ مَنْ اٰمَنَ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ وَ اَقَامَ الصَّلٰوةَ وَ اٰتَی الزَّكٰوةَ وَ لَمْ یَخْشَ اِلَّا اللّٰهَ فَعَسٰۤی اُولٰٓىِٕكَ اَنْ یَّكُوْنُوْا مِنَ الْمُهْتَدِیْنَ
তারাই তো আল্লাহর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে, যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও আখিরাতে, আর সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায় তারা হবে হেদায়েতপাপ্তদের অর্ন্তভূক্ত। [সূরা আত-তাওবা, ৯ : ১৮] কাজেই এ যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিদেরকেই কমিটিতে রাখা।
সমস্যা-৩
বাংলাদেশের অধিকাংশ মসজিদে খতিব, ইমাম, মুয়াজজিনদের হ্যান্ডসাম স্যালারি, আবাসন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়না। উচ্চশিক্ষিত, ভালো যোগ্যতা সম্পন্ন খতিব ও ইমাম নিয়োগ হয়না ফলে মসজিদকেন্দ্রীক সমাজ উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয়।
সমাধান:
মসজিদে খতিব, ইমাম, মুয়াজজিনদের নিয়োগে উচ্চশিক্ষিত, ভালো যোগ্যতা সম্পন্ন খতিব ও ইমাম নিয়োগ দিতে হবে এবং তাদের হ্যান্ডসাম স্যালারি, আবাসন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যাতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে মসজিদের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন।
সমস্যা-৪
নামাজে মসজিদের খতিবকে যে অর্থে ইমাম বা নেতা বানিয়ে তার আনুগত্য করা হয়। ঠিক একই অর্থে সমাজ ব্যবস্থায় ইমামের নেই কোনো নেতৃত্ব। নেই কোনো সামাজিক মর্যাদা ও দায়বদ্ধতা।
সমাধান:
ইমামের নেতৃত্ব শুধু মসজিদের নামাজ পরিচালনার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যাবে না। বরং সকল মসজিদ ভিত্তিক সামাজিক কার্যক্রম, সালিস ও বিচারের নেতৃত্ব , বিবাহ-শাদি, দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমে তার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
মসজিদভিত্তিক সমাজ উন্নয়নের রূপরেখা বাস্তবায়নে প্রস্তাবনা
আমরা মসজিদভিত্তিক আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্খী। সালাত আদায়ের পাশাপাশি রাসূলের সা. মসজিদে যেসব কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হতো, আমরা আমাদের মসজিদকেন্দ্রীক সেসব কর্মসূচী যদি বাস্তবায়ন করতে চাই তাহলে নিম্নলিখিত কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে:
১। মসজিদ-ভিত্তিক দীনি শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা:
পুরুষের পাশাপাশি নারীদের জন্য পৃথক সালাত আদায় ও দীনি শিক্ষা-ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা। যেখানে থাকবে শিশুদের জন্য প্লে-গ্রাউন্ড, যেন তারা মসজিদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। মসজিদের একপাশে অমুসলিমদের কর্নার থাকবে; যেন তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে খুতবা শ্রবণসহ ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে।
২। উচ্চতর ইসলামী গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা:
জ্যেষ্ঠ ইসলামিক স্কলারদের তত্ত্বাবধানে নবীন মেধাবী আলেমদেরকে দুই-তিন বছরের কোর্সের মাধ্যমে যুগচ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যোগ্য করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে মসজিদভিত্তিক গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা। এই কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন দীনি বিষয়ে গবেষণা করা হবে। এই কেন্দ্রে সরাসরি বিজ্ঞ আলেম ও প্রশিক্ষিত মুফতীগণের সঙ্গে সাক্ষাত করে দীনি সমস্যার সমাধান জানা যাবে।
৩। বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা:
মসজিদভিত্তিক চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে গরিব-অসহায় রোগীদেরকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা-সহায়তা প্রদান করা। ক্ষেত্রবিশেষ ওষুধ ও উন্নত চিকিৎসার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৪। ফ্যামিলি কাউন্সেলিং বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা:
দাম্পত্য-কলহ নিরসনকল্পে ও পারিবারিক ব্যবস্থা আরো সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে এই বিভাগ কাজ করবে। সমাজতত্ত¡বিদ ও বিজ্ঞ আলেমদের মাধ্যমে বিবাহেচ্ছু ও বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা।
৫। পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা:
সর্বসাধারণকে দীনি ও উপকারী বই-পুস্তক পড়তে উৎসাহিত করার জন্যে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত বৃহৎ পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা।
৬। শিশু-কিশোরদের জন্য ইসলামী সংস্কৃতিকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা:
শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য সুস্থ বিনোদনচর্চা অপরিহার্য। অথচ আজকাল শিশুরা অনেকটাই অবহেলিত। শিশু-কিশোরদের সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা এই কেন্দ্রের মূল উদ্দেশ্য। এখান থেকে সংস্কৃতিচর্চার পাশাপাশি ইসলামের মৌলিক আকীদা ও বিধানাবলি শিক্ষাদান করা।
৭। মসজিদকে কেন্দ্র করে মহল্লা/গ্রামভিত্তিক সামাজিক উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণ কমিটি গড়ে তোলা। এলাকার সকল মুসল্লিদেরকে সদস্য করা। মসজিদে নিয়মিত নামাজি লিডার কার্যক্রম পরিচালনা করবে। অপেক্ষাকৃত তরুণদেরকে কাজে যুক্ত করে, ইমাম, খতিব এবং শিক্ষিত জনশক্তি ও তরুণদের নেতৃত্ব দিতে হবে। মুসল্লিদের যাকাত, দান ও এককালীন অনুদানই এর একমাত্র আয়ের উৎস। এলাকার যেসব বিত্তবান মানুষ শহরে-বন্দরে ভালো চাকরি করে, বিদেশে থাকে তাদের কাছ থেকে কালেকশন করা। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা।
৮। ঈদ, দুর্যোগকালীন ও শীতকালে মহল্লার ধনী মুসল্লিদের উৎসাহিত করে, বিধবা, বৃদ্ধ ব্যক্তি ও দরিদ্র মুসুল্লিদের পাশে দাঁড়ানো। খাদ্য ও পোশাক বিতরণ করা। আয় রোজগারের জন্য আত্ম-কর্মসংস্থানমুলক প্রোগ্রাম গ্রহণ করা। যাকাত ও সাদাকাহ ফান্ড এর মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ করা।
৯। মহল্লায় যারা কুরবানি দেয় তাদের থেকে গোশত সংগ্রহ করে, যারা কুরবানী দিতে পারেনি, তাদের তালিকা তৈরি করে ইমাম সাহেবের নেতৃত্বে তাদের বাসায় গোশত পৌঁছে দেওয়া।
১০। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সাদাকা তহবিল থেকে কুড়াল, কোদাল, দাঁড়িপাল্লা ইত্যাদি যন্ত্রপাতি ক্রয় করে রাখা। যার যখন প্রয়োজন হবে ইমাম সাহেবের কাছে নাম ও ফেরত দেওয়ার সময় লিখে নিয়ে যাবে। কাজ শেষে যথাযথভাবে পৌঁছে দেবে।
১১। কর্জে হাসানার প্রতি উৎসাহিত করে কর্জে হাসানাহ ফান্ড গঠন করা। আপদকালীন সময়ের জন্য উক্ত ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। অত্যন্ত শৃঙ্খলার সাথে সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
১২। প্রতিটি মসজিদে মক্তব চালু করা। যেখানে মক্তব চালু আছে সেখানে পাঠাগার শিক্ষা কেন্দ্র ও ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু করতে হবে। কুরআন ও হাদিস প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা।
১৩। বিয়ে-শাদি মসজিদে করার জন্য উৎসাহিত করা। মানুষকে মসজিদমুখী করার জন্য উৎসাহিত করা। নিয়মিত নামাজ পড়লে শিশুদের উৎসাহ দিতে পুরস্কার প্রদান করা। এক্ষেত্রে অবশ্যই মসজিদের শিষ্টাচার রক্ষা করতে হবে এবং ইসলামী আদর্শ ও নীতিমালার আলোকে মসজিদ পরিচালনা নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার:
মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল সমাজ গঠন করা সম্ভব। দরকার সামাজিক উদ্যোগের। যাকাত ও সাদাকাহ ফান্ড গঠন করে সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রোগ্রাম গ্রহণ করে মসজিদকে সামাজিক উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলা। মসজিদের শিষ্টাচার অক্ষুন্ন রেখে মসজিদকে ইবাদত, দ্বিনি শিক্ষা এবং মানবিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র হিসেবে আমানতদারীর সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে। তাহলেই আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ তথা মসজিদ ভিত্তিক সমাজ উন্নয়ন সহজ ও তরান্বিত হবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক: ইমাম ও খতিব, সেনা কেন্দ্রীয় মসজিদ, ঢাকা।