পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের কোম্পানি উত্তরা ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডে চলছে নয়ছয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিতে চলছে অবৈধ লেনদেন, অনুমোদন ছাড়া পুঁজিবাজারে অর্থ বিনিয়োগ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কয়েকজন পরিচালক নিয়ম ভেঙে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির আমানত এবং ঋণের তথ্য আড়াল করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে গোপনে অর্থ দেওয়া হয়েছে। এমনকি ভুয়া শিরোনামে উত্তরা ফাইন্যান্স থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এছাড়া বনেদি উত্তরা মোটরস জড়িয়ে পড়েছে আর্থিক অনিয়মে। উত্তরা মোটরসের হাত ধরে উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের যাত্রা শুরু হলেও সেই প্রতিষ্ঠানকেই গিলে খাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছে উত্তরা মোটরস। এরই মধ্যে হাজার কোটি টাকা খেয়ে ফেলেছে তারা। এর বাইরে কয়েকজন পরিচালক বিভিন্ন নামে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি থেকে টাকা বের করে নিয়েছেন।
সে অর্থ তারা পুঁজিবাজারে খাটিয়েছেন, নিজের ব্যবসাতেও ব্যবহার করেছেন। এছাড়া শুধু পরিচালকরা নন, লুটপাটের সময় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন না। বর্তমানে উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড লুটপাটের কারণে এখন রুগ্ন অবস্থায় রয়েছে। এরই মধ্যে উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৭১২ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মাধ্যমে কোম্পানিটির নিরীক্ষক এ তথ্য দিয়েছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন ২০২০ সাল থেকে অপ্রকাশিত রয়েছে। ফলে কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘ বছর ধরে অনেকটা অন্ধকারে রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে সোমবার ডিএসইর মাধ্যমে কোম্পানির ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর নিরক্ষকের মতামত প্রকাশ করা হয়েছে।
নিরীক্ষক তার মতামতে জানিয়েছেন, ২০২০ সালে কোম্পানির সুদ বাবদ লোকসান হয়েছে ৬১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। আর ওই বছরে মোট পরিচালন লোকসান দাঁড়িয়েছে ১০৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অন্যান্য ব্যয় বহন শেষে শেয়ারপ্রতি ৩৩ টাকা ১৩ পয়সা লোকসান হারে কর পরবর্তী নিট লোকসান হয়েছে ৪৩৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। নিরীক্ষক আরও জানায়, ২০২০ হিসাব বছরে কোম্পানির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭১১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে যোগ্য মূলধন ঘাটতি ৫৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় মূলধন ঘাটতি ৬৫২ কোটি ২১ লাখ টাকা।
২০২০ হিসাব বছরে কোম্পানিটি তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউএফআইএল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডকে ১৪৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। এর বাইরে প্রতিষ্ঠানটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া আরও ১ হাজার ৩৭৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা লেনদেন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোম্পানিটি লেনদেন অনুমোদন ও ঋণ পরিশোধের জন্য প্রতিষ্ঠিত অভ্যন্তরীণ পদ্ধতি, ঋণগ্রহীতার যথাযথ সতর্কতা এবং বিচক্ষণতা নির্দেশিকা অনুসরণ না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধান লঙ্ঘন করেছে।
এদিকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির অনুমোদনহীন বকেয়া লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৫৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এর মধ্যে বেশিরভাগই স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। অনুমোদনহীন এবং দীর্ঘ বছরে সমন্বয় না হওয়ায় ওই বকেয়ার বিপরীতে কোম্পানির ব্লক দায় ২ হাজার ১৫০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ডিএসইকে এই নিরীক্ষক আরও জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ব্যাংকের ২০২০ সালের ৩ আগস্ট জারি হওয়া এফআইডি সার্কুলার নম্বর ৮ অনুসারে, বকেয়া সম্পদ এক বছরের বেশি সময় সমন্বয়হীনভাবে থাকলে তার বিপরীতে শতভাগ সঞ্চিতি গঠন করতে হয়। তবে কোম্পানিটি এক্ষেত্রে কোনো ধরনের সঞ্চিতি গঠন করেনি।
১৯৯৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টসের অনুমোদিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকা। যার বিপরীতে পরিশোধিত মূলধন রয়েছে ১৩১ কোটি ৪৮ লাখ ২০ হাজার টাকা। কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা ১৩ কোটি ১৪ লাখ ৮১ হাজার ৫০৪টি। এর মধ্যে ৫৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকরী, বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে।
এদিকে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ৮৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মুন্নু ফেব্রিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আফরোজা খান রিতাসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে পৃথক ৪টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি দুদকের ঢাকা জেলা কার্যালয়ে মামলাগুলো দায়ের করা হয়। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশ করে কোনো রকম রেকর্ডপত্র জমা না দিয়ে বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই উত্তরা ইনভেস্টমেন্ট ফাইন্যান্স লিমিটেডের হিসাব থেকে ২৬ কোটি টাকা মুন্ন ফেব্রিকস লিমিটেডের হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করার অপরাধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এরপর একই প্রক্রিয়ায় উত্তরা ইনভেস্টমেন্ট ফাইন্যান্স লিমিটেডের হিসাব থেকে ২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা, আরেক দফায় ১৯ কোটি টাকা এবং ২০ কোটি টাকা মুন্ন ফেব্রিকস লিমিটেডের হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে উত্তোলনপূর্বক আত্মসাতের অভিযোগে আরও তিনটি মামলা দায়ের করা হয়।
মামলার আসামিরা হলেন, উত্তরা ইনভেস্টমেন্ট ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এসএম শামসুল আরেফীন, মুন্নু ফেব্রিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফরোজা খান রিতা, উত্তরা ফাইন্যান্সের সাবেক সিনিয়র অফিসার মিঠু কুমার সাহা, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন, কাজী আরিফুজ্জামান, সাবেক অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএ কামরুজ্জামান ও সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার রাফিউল ইসলাম।
সম্পাদক ও প্রকাশক: জোনায়েদ মানসুর, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৫৬ পুরানা পল্টন, ঢাকা -১০০০। রেজিস্টার্ড : ২৯২ ভূইয়া পাড়া প্রধান সড়ক, খিলগাঁও, ঢাকা- ১২১৯। সম্পাদকীয়: ০১৭৮৯৪২১৪৪৪, বার্তাকক্ষ : ০১৯১৩৫৫৫৩৭১। ই-মেইল: inextpr@gmail.com , (বিজ্ঞাপন), newsuddokta@gmail.com (বার্তাকক্ষ)