চট্টগ্রাম সংবাদাতা: ব্যাংক আমানতের সুদ বৃদ্ধিতে পোয়াবারো অবস্থা জ্বালানি খাতের সরকারি তিন কোম্পানির। কোম্পানি তিনটির সুদ আয় বেড়ে যাওয়ায় মুনাফায়ও বড় উল্লম্ফন হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কোম্পানি তিনটির মূল ব্যবসার চেয়ে এখন আমানতের সুদ আয় কয়েক গুণ বেশি। কোম্পানি তিনটি হলো পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েল। গ্রাহক পর্যায়ে জ্বালানি তেল বিক্রেতা এই তিন সরকারি কোম্পানিই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত।
সম্প্রতি কোম্পানিগুলো তাদের তৃতীয় ত্রৈমাসিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের (জুলাই-মে) আয়-ব্যয়ের তথ্য তুলে ধরা হয়। কোম্পানি তিনটির আর্থিক প্রতিবেদনগুলো আলাদাভাবে পর্যালোচনা করে তাদের মূল ব্যবসার তুলনায় কয়েক গুণ বেশি সুদ আয়ের তথ্য পাওয়া গেছে।
আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জ্বালানি খাতের সরকারি এই তিন কোম্পানি মিলে গত ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সম্মিলিতভাবে ব্যাংকে আমানত রেখে সুদ আয় করেছে ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এ সময়ে কোম্পানি তিনটির সম্মিলিত পরিচালন মুনাফা ছিল ২৩৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে কোম্পানিগুলোর মূল্য ব্যবসা থেকে যে মুনাফা হয়েছে, তার চেয়ে সোয়া ছয় গুণ বেশি ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ আয় করেছে। আর এই সুদ আয় কোম্পানিগুলোর মুনাফা বাড়িয়ে দিয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
জ্বালানি খাতের সরকারি তিন কোম্পানির মধ্যে উল্লেখিত ৯ মাসে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে যমুনা অয়েল। কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে মার্চ—এই ৯ মাসে কোম্পানিটি ৪৬৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। অথচ এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির মূল ব্যবসার আয়-ব্যয় সমন্বয়ের পর পরিচালন মুনাফা ছিল প্রায় ৩৪ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ৫৫৪ কোটি টাকার সুদ আয় যুক্ত হয়। পরে সেখান থেকে কর, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল ও সহযোগীদের মধ্যে লাভের অর্থ বণ্টনের পর প্রকৃত মুনাফা দাঁড়ায় ৪৬৫ কোটি টাকা।
আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-মার্চ সময়কালে যমুনা অয়েল মূল ব্যবসা থেকে আয় করে ১১১ কোটি টাকা। এ সময়ে ব্যাংক থেকে সুদ বাবদ আয় ছিল ৫৫৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে কোম্পানিটি মূল ব্যবসার চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি আয় করে সুদ বাবদ। এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির সুদ আয় বেড়েছে ১৪৭ কোটি টাকা।
এদিকে দেশের পেট্রোলিয়াম জ্বালানি আমদানি থেকে শুরু করে পরিশোধন ও গ্রাহকপর্যায়ে বিপণন নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তিন অঙ্গ প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েল কোম্পানির মাধ্যমে এসব জ্বালানি বিপণন করে সংস্থাটি। নির্ধারিত পেট্রোলিয়াম পণ্য বিক্রির বিপরীতে বিপিসি থেকে লিটারপ্রতি নির্ধারিত হারে কমিশন পায় বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান তিনটি। বিপিসি থেকে বাকিতে পায় তারা। বাকিতে কিনে নগদে বিক্রি করে। তবে তেল বিক্রির চেয়ে গত পাঁচ বছরে নন-অপারেশনাল খাত থেকে বেশি আয় করেছে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা।
নিরীক্ষিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত পাঁচ বছরে তিন কোম্পানির (কর পরবর্তী) নিট লাভ চার হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অপারেশনাল প্রফিট এক হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। অবশিষ্ট আয় এসেছে ব্যাংক সুদ থেকে। অভিযোগ আছে, বিপিসির বকেয়া নিয়মিত পরিশোধ না করে জমিয়ে রাখা টাকা ব্যাংকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করে মূল ব্যবসার বাইরে ব্যাংক সুদে বেশি লাভবান হচ্ছে অঙ্গ প্রতিষ্ঠান তিনটির।
তিন বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম এবং যমুনা অয়েল কোম্পানি বিপিসি থেকে পেট্রোলিয়াম পণ্য পেয়ে তা বিপণন করে। তারা পণ্য হিসেবে ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন, কেরোসিন, ফার্নেস অয়েল, মেরিন ফুয়েল, জেট ফুয়েল সরাসরি বিপিসি থেকে পায়। মূলত পেট্রোলিয়াম পণ্য কেনায় বিপণন কোম্পানি তিনটিকে আগাম কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হয় না বিপিসিকে। তবে নিজেদের ডিলার ও এজেন্টদের কাছ থেকে আগাম পে-অর্ডার নিয়ে এসব পণ্য বিক্রি করে কোম্পানি তিনটি।
নির্ধারিত পেট্রোলিয়াম পণ্য বিক্রির বিপরীতে বিপিসি থেকে লিটারপ্রতি নির্ধারিত হারে কমিশন পায় বিপণন প্রতিষ্ঠান তিনটি। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সবশেষ গত ২১ আগস্ট তারিখের গেজেট অনুযায়ী বর্তমানে লিটারপ্রতি ডিজেলে ৭০ পয়সা, কেরোসিনে ৮০ পয়সা এবং অকটেন-পেট্রোলে ৯০ পয়সা করে মার্জিন পাচ্ছে বিপিসির বিপণন কোম্পানিগুলো। এর আগে ডিজেল-কেরোসিনে লিটারপ্রতি ৫০ পয়সা করে ও পেট্রোল-অকটেনে লিটারপ্রতি ৬০ পয়সা করে মার্জিন (কমিশন) পেতো বিপণন কোম্পানিগুলো।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের তিন কোম্পানির বার্ষিক ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ৩০ জুন বিভিন্ন ব্যাংকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ডিপোজিটসহ তিন কোম্পানির নগদ ও ব্যাংক স্থিতি ছিল ১৭ হাজার ৩৪ কোটি ৫৯ হাজার ৩৪০ টাকা। এর মধ্যে পদ্মা অয়েলের নগদ ও ব্যাংকে জমা ছিল ৫ হাজার ৪৯০ কোটি ৬৪ লাখ ১৯ হাজার টাকা, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের নগদ ও ব্যাংকে জমা ছিল ৫ হাজার ৪৭৭ কোটি ১৭ লাখ ৯৫ হাজার ৫৫ টাকা এবং যমুনা অয়েলের নগদ ও ব্যাংকে জমা ছিল ৬ হাজার ৬৬ কোটি ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ২৮৫ টাকা।
এদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিসির নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৩০ জুন তিন কোম্পানি থেকে বিপিসির পাওনা ছিল ২৪ হাজার ৫৭৯ কোটি ৬৪ লাখ ৯৮ হাজার ৪২১ টাকা। এর মধ্যে পদ্মা অয়েল থেকে ৯ হাজার ৩৬৯ কোটি ৫৮ লাখ ২৯ হাজার ৯৬৪ টাকা, মেঘনা পেট্রোলিয়াম থেকে ৭ হাজার ২৩৩ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার ৩৬৫ টাকা এবং যমুনা অয়েল থেকে ৭ হাজার ৯৭৬ কোটি ৯৭ লাখ ১৭ হাজার ৯২ টাকা বিপিসির পাওনা ছিল।
পদ্মা অয়েল কোম্পানির ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই অর্থবছর পদ্মা অয়েলের অপারেটিং মুনাফা হয়েছে ১৪৫ কোটি ৮৯ লাখ ২৬ হাজার টাকা। ওই বছর এফডিআরসহ ব্যাংক জমার ইন্টারেস্ট খাতে নন-অপারেটিং আয় হয়েছে ৩৯১ কোটি ৬৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। একই অর্থবছর পদ্মা অয়েল কর পরিশোধ পরবর্তী নিট মুনাফা করেছে ৪০৮ কোটি ৫৮ লাখ ৯২ হাজার টাকা।
একইভাবে পদ্মা অয়েল কোম্পানি ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে অপারেটিং প্রফিট করেছে মাত্র ৪৩৪ কোটি ২৭ লাখ ২৬ হাজার টাকা। একই সময়ে পদ্মা অয়েলের নন-অপারেটিং আয় হয়েছে ১৫৬৮ কোটি ৬০ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক সুদ হচ্ছে ১৫৩৪ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা। পদ্মা অয়েল কোম্পানি ৫ বছরে নিট প্রফিট (কর পরবর্তী) করেছে ১৫শ কোটি ৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।
একইভাবে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই বছরে তাদের অপারেটিং মুনাফা হয়েছে ১৫৮ কোটি ৭৪ লাখ ৯৯ হাজার ৭৬৪ টাকা। ওই বছরে কোম্পানিটিতে এফডিআরসহ ব্যাংক জমার ইন্টারেস্ট খাতে নন-অপারেটিং আয় হয়েছে ৫২৭ কোটি ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৫৫ টাকা।
একই অর্থবছর মেঘনা পেট্রোলিয়াম কর পরিশোধ পরবর্তী নিট মুনাফা করেছে ৫৪২ কোটি ২৯ লাখ ৭২ হাজার ৯৫৪ টাকা। ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত মেঘনা পেট্রোলিয়াম পাঁচ বছরে অপারেটিং প্রফিট করেছে মাত্র ৬৭৯ কোটি ৯৭ লাখ ৪ হাজার ১৩ টাকা। একই সময়ে কোম্পানির নন-অপারেটিং আয় হয়েছে ১৮৯২ কোটি ৮১ লাখ ৯৪ হাজার ৩৫৩ টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক সুদ হিসেবে আয় হয়েছে ১৭শ ৭১ কোটি ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫২২ টাকা। মেঘনা পেট্রোলিয়াম পাঁচ বছরে নিট প্রফিট (কর পরবর্তী) করেছে ১৮শ ৯১ কোটি ৩ লাখ ৯ হাজার ৮০ টাকা।
পদ্মা অয়েল ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের মতোই অপারেটিং মুনাফার চেয়ে ব্যাংক সুদে আয় বেশি করেছে যমুনা অয়েল কোম্পানিও। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যমুনা অয়েলের বার্ষিক ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই অর্থবছর যমুনা অয়েল অপারেটিং মুনাফা করেছে মাত্র ৪৫ কোটি ৪১ লাখ ৫২ হাজার ৮৯৪ টাকা। ওই বছর এফডিআরসহ ব্যাংক ইন্টারেস্ট হিসেবে আয় হয়েছে ৫১৯ কোটি ৫৫ লাখ ৯৫ হাজার ৬৫৬ টাকা।
এতে কোম্পানিটি কর পরিশোধ পরবর্তী নিট মুনাফা করেছে ৪৪১ কোটি ৬৭ লাখ ৩৬ হাজার ৪২৫ টাকা। ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত যমুনা অয়েল কোম্পানি পাঁচ বছরে অপারেটিং প্রফিট করেছে মাত্র ১৮৫ কোটি ১৪ লাখ ৭১ হাজার ৭৪৮ টাকা। একই সময়ে কোম্পানির নন-অপারেটিং আয় হয়েছে ১৭শ ৩৩ কোটি ৪৪ লাখ ২৩ হাজার ২৭৯ টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক সুদ হিসেবেই আয় হয়েছে ১৫শ ৫১ কোটি ৫০ লাখ ৬৪ হাজার ৯০৮ টাকা। যমুনা অয়েল ওই পাঁচ বছরে নিট প্রফিট (কর পরবর্তী) করেছে ১৩শ ৭০ কোটি ৪৬ লাখ ৩৫ হাজার ৭৪০ টাকা।
এ বিষয় জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও বেসরকারি ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটির বাণিজ্য অনুষদের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা বলেন, সাধারণত কোম্পানির পরিচালন আয়কেই মূল আয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর বাইরে সুদসহ অন্যান্য খাতের আয় সব সময় এক থাকে না। এ কারণে মূল ব্যবসায়ের আয় বাড়লে সেটি কোম্পানির জন্য টেকসই হয়।
যেহেতু জ্বালানি খাতের সরকারি তিন কোম্পানির হাতে প্রচুর নগদ অর্থ আছে, তাই ব্যাংকের বেশি সুদের সুফল পাচ্ছে তারা। যত দিন আমানতের সুদ বেশি থাকবে, তারা এই সুফল পাবে। তবে কখনো সুদ অনেক কমে গেলে তখন কোম্পানিগুলোর মুনাফা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাবে। তখন শেয়ারের দামেও তার প্রভাব পড়বে।