পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা খাতের কোম্পানি রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স পরিনত হয়েছে জাল-জালিয়াতি, অনিয়ম, দুর্নীতি ও ভুয়া বিল-ভাউচারের আখড়া। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. গোলাম কিবরিয়া কোম্পানির টাকা আত্মসাত করে বহুতল ভবন নির্মাণ, ফ্ল্যাটসহ নামে-বেনামে অবৈধভাবে গড়েছেন বিপুল সম্পদ। এছাড়া কোম্পানিতে সিন্ডিকেট তৈরি করে কর্মকর্তাদের অবণ্টনকৃত কমিশন বিল আত্মসাৎ, পারিবারিক ভ্রমণ ব্যয় দেখিয়ে কোম্পানির তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাৎ, আপ্যায়ন বিল উত্তোলন করে আত্মসাৎ, উন্নয়ন সভার নামে অর্থ আত্মসাতসহ বিভিন্ন দিবস ও প্রচারণা বিল উত্তোলন করে আত্মসাৎ এবং কোম্পানির ভবিষ্যত তহবিল থেকে টাকা তছরুপের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির সিইও মো. গোলাম কিবরিয়ার অনিয়ম ও দুর্নীতির চরমে উঠেছে। তিনি অনিয়মকে নিয়ম বলে চালিয়ে যাচ্ছেন। কোন কিছু তোয়াক্কা করছেন না। তার অনিয়মগুলো যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আইন লঙ্ঘন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অনিয়মের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি। তার অনিয়ম ও অনৈতিক পন্থায় অত্যন্ত সুক্ষ্ম এবং সুপরিকল্পিতভাবে আত্মসাত করেছেন কোম্পানির কোটি কোটি টাকা। যার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ১২ লাখ গ্রাহকের শত শত কোটি টাকার আমানত।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি আইডিআরএ চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো হয়েছে। চিঠির সঙ্গে মো. গোলাম কিবরিয়ার বিরুদ্ধে জমা পড়া অভিযোগের কপি সংযুক্ত করে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
রূপালী লাইফের ডেপুটি ম্যানেজার (নিরীক্ষা বিভাগ) মো. জহিরুল ইসলাম এ অভিযোগ দিয়েছেন। রূপালী লাইফের ডেপুটি ম্যানেজার (নিরীক্ষা বিভাগ) মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ দিন যাবত অনিয়ম এবং দুর্নীতির মাধ্যমে কোম্পানি থেকে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে আসছেন গোলাম কিবরিয়া সিন্ডিকেট। এসব বিষয় নিয়ে কেউ কথা বললে তাকে চাকরিচ্যুত করাসহ বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, আমকেও বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। যেকোন মুহূর্তে চাকরি থেকে টার্মিনেটও করে দিতে পারে।
অভিযোগের কপি অর্থ উপদেষ্টাকে দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনকেও দেওয়া হয়েছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মো. গোলাম কিবরিয়া ২০০০ সালে ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ দেখিয়ে রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে এজিএম হিসেবে যোগ দেন। পরে ভুয়া এমবিএ সনদ দেখিয়ে ২০১৪ সালে সিইওর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
কোম্পানির উন্নয়ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে বছর শেষে অবণ্টনকৃত বিভিন্ন কমিশন বিল, ইনসেনটিভ বিল, বেতন ভাতার ৯৯ হাজার তিনশ ৭৯ টাকা অবৈধভাবে আত্মসাৎ করেন। আর এই কাজে তাকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন কোম্পানির কমিশন ইনচার্জ আকতার হোসেন এভিপি ও সাবেক ইনচার্জ জাহাঙ্গীর হোসেন -ডিভিপি। নিয়ম অনুযায়ী কমিশন সংক্রান্ত যেকোন বিল সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পরিশোধের নিয়ম থাকলেও এই ক্ষেত্রে সেটা মানা হয়নি। এই খাতে এভাবে বছরের পর বছর জাল জালিয়াতির মাধ্যমে লুট করা হয়েছে বিপুল অংকের অর্থ।
ওই অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, গোলাম কিবরিয়া রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন জাল জালিয়াতির মাধ্যমে কোম্পানির ভবিষ্যত তহবিল থেকে ৬০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। যা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও নিয়ম বর্হিভূত কাজ। এ বিষয়ে অর্থ ও হিসাব বিভাগের কর্মকর্তা আকতার হোসেন এভিপিকে জিজ্ঞাসা করা হলে বিস্তারিত তথ্য বেরিয়ে আসবে বলেও জানানো হয়। গোলাম কিবরিয়া পারিবারিক ভ্রমণের খরচও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কোম্পানি থেকে হাতিয়ে নেন। তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করে সেই বিলও কোম্পানির তহবিল থেকে আদায় করেন। গত ২০ থেকে ২২ ডিসেম্বর পারিবারিক ভ্রমণে ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম যান। সেই বাবদ তিনি কোম্পানি থেকে ৩৫ হাজার নয় শত ৯৯ টাকা উত্তোলন করেন। যা সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূত কাজ। এভাবে তিনি দীর্ঘদিন যাবত কোম্পানির টাকা আত্মসাত করে আসছেন। এখানেই শেষ নয়, ব্যবসা বৃদ্ধির নামে কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রমোদ করেন তিনি।
এভাবে কোম্পানির লাখ লাখ টাকা তছরুপ করছেন বলেও উল্লেখ করা হয় ওই অভিযোগপত্রে। সিইও গোলাম কিবরিয়া বিভিন্ন সময়ে তার দপ্তরে আসা উন্নয়ন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আগমন দেখিয়ে সেই কর্মীদের নামে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে, আপ্যায়ন বিল হিসেবে তা আত্মসাৎ করেন। এভাবে বছরের পর বছর ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে কোম্পানির লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে আসছেন তিনি।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, গোলাম কিবরিয়া কোম্পানির ব্যবসা বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ এবং উন্নয়নের নামে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে লাখ লাখ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। গত ডিসেম্বরের ভাউচার অনুযায়ী, তিনি ভুয়া বিল তৈরি করে এক মাসে ৮২ হাজার আটশত টাকা আত্মসাৎ করেন। অনুরূপভাবে বছরের পর বছর বিভিন্ন কায়দায় তিনি কোম্পানির টাকা আত্মসাৎ করে আসছেন।
এছাড়া তথ্য গোপন করে বিতর্কিত শিক্ষা সনদ দিয়ে সিইও পদে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিতর্কিত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মো. গোলাম কিবরিয়ার বিবিএ, এমবিএ সনদ ভুয়া বলে প্রকাশিত হওয়ার পর, তার পরের দিন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন (ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত) থেকে তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন।
বিতর্কিত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভুয়া বিবিএ, এমবিএ সনদ গ্রহণ করে এবং ওই সনদ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর কাছে দাখিল করে ১০ বছর কোম্পানিতে সিইও হিসেবে কর্মরত।
এসব বিষয়ে জানতে রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়াকে উদ্যোক্তা বাংলাদেশ থেকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানী সেক্রেটারি মো. আমিরুল ইসলাম (মুকিত) লিখিতভাবে জবাব দেন। তিনি উদ্যোক্তা বাংলাদেশকে বলেন, রূপালী লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানী লিমিটেড বর্তমানে দেশের বীমা শিল্পে খ্যাতিমান একটি জীবন বীমা কোম্পানী। দেশের প্রচলিত বীমা আইন যথাযথভাবে পরিপালন করে সম্মানিত বীমা গ্রাহকদের দাবী যথাসময়ে পরিশোধে কোম্পানী সর্বদা বদ্ধপরিকর। সূচনা লগ্ন থেকে এ পর্যন্ত অত্র কোম্পানী সম্মানিত বীমা গ্রাহকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার পরিচয় দিয়ে আসছে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানীর বীমা পরিশোধের হার ৯৯.৪৪ শতাংশ। যা এদেশের বীমা শিল্পে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত। রিপোর্টিতে মনগড়া বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। রূপালী লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানী লিমিটেড দেশের প্রচলিত বীমা আইন পরিপালন করে এদেশে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। একটি কুচক্রীমহল এ কোম্পানীর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার ও গুজব ছড়িয়ে কোম্পানীর ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
অভিযোগসমূহ মোটেও সত্য এবং বাস্তবসম্মত নয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে রূপালী লাইফের অগ্রযাত্রাকে রোধ করার জন্য একটি স্বার্থান্বেষী মহল নানা অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
রূপালী লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানী লিমিটেড বীমা আইন অনুযায়ী তার সার্বিক কর্মকান্ডে সর্বদা স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে আসছে। আমরা আমাদের সম্মানিত বীমা গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা করে এ দেশের জীবন বীমা শিল্পে এগিয়ে যাব ।