দেশের কৃষি সেক্টরে কৃষক বা খামারি তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। বাজার ব্যবস্থাপনায় অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি এর অন্যতম কারণ। এছাড়া ডেইরি শিল্পে বিরাজমান পরিস্থিতি, বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, উত্তরণ এবং উন্নীতকরণের কৌশল সম্পর্কে আমাদের বিশেষ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা সময় ব্যয় করি না। দেশের কৃষি অর্থনীতিকে বেগবান করতে এ খাতে সরকারের আরো বেশি মনোযোগ দেয়া দরকার বলে মনে করি। ডেইরি শিল্পকে সফল করতে হলে দেশেই ডেইরি মেডিসিন বানাতে হবে। এই সেক্টরে বিশাল একটা অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
বর্তমানে ডেইরিতেও অবস্থা বেশি ভালো নয়। মানুষ ২০ টাকা দিয়ে একটা ২০০ এমএল জুস কিনে খেতে পারে অথচ ২০ টাকা দিয়ে ২৫০ মিলি দুধ খেতে চায় না। অথচ জুসের চেয়ে কিন্তু দুধের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। এক্ষেত্রে ভোক্তাদের সচেতন করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচার হচ্ছে আমাদের দেশে নাকি প্লাস্টিকের ডিম পাওয়া যায়, চাল পাওয়া যায়, টিস্যু দিয়ে, শ্যাম্পু দিয়ে নাকি দুধ তৈরি করা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষ কিন্তু এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুকে সময় কাটায়। তাই উনারা ওখানে যা দেখে তাই বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে আমাদের ভোক্তাদের সচেতন করে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি বারবার একটা কথাই বলি, আমাদের মধ্যে একতা থাকতে হবে। তথ্য নির্র্ভুল ছোট ছোট ভিডিও করে আমরা ইউটিউবে এ প্রচার করতে পারি, সোশ্যাল মিডিয়ায়ও প্রচার করতে পারি। আমাদের দেশের ক্রেতা নিজের দেশের প্রোডাক্ট মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে। তারা আমদানি করা ড্রাগন ফল খাবে ৬০০-৮০০ টাকা দরে কিন্তু আমাদের দেশের ড্রাগন ফল ২৫০-৩০০ টাকা দিয়ে খাবে না। অথচ আমাদের দেশের ড্রাগনফল আমদানি করা ড্রাগনফলের চেয়ে অনেক অনেক সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। এজন্য শুধু ভোক্তাদের দায়ি করলে চলবে না। কারণ, আমাদের দেশে সাধারণত যে ফরমেটে খামার করা হয় উন্নত রাষ্ট্রে কিন্তু এভাবে হয় না। তাদের দেশের ভোক্তারা খামারিদের ওপর আস্থা রাখতে পারে কারণ তারা জানে যে, খামার থেকেই চিকেন নেয়া হোক না কেন তাদের কোনো সমস্যা হলে তাদের দেশের সরকার, খামারি বা বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশন সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তাই সেসব দেশের ভোক্তাদের তাদের দেশের প্রোডাক্টের ওপর পূর্ণ আস্থা আছে। আমাদেরও সেই আস্থার জায়গাটা প্রমাণ দিয়ে তৈরি করতে হবে। আমাদের এমন টেকনোলজি ব্যবহার করতে হবে যেন ভোক্তা নিজেই পণ্যের মান যাচাই করতে পারে। এক্ষেত্রে আমি ভোক্তাদের উদ্দেশে একটি কথা বলতে চাই, আপনারা একটু সময় পেলে আপনার আশপাশে যে খামারগুলো আছে সেখানে যান। দেখেন তারা মুরগিকে কী খাওয়াচ্ছে, কোন কোম্পানির ফিড খাওয়াচ্ছে, এতে কী কী উপাদান আছে। সেগুলো বাসায় এসে গুগুলে সার্চ করে দেখেন যে, ফিডে উপাদানগুলো আছে সেগুলো আমাদের শরীরের জন্য ভালো কি না। দয়া করে গুজবে কান দেবেন না। এছাড়াও আমরা যে এত সভা-সেমিনার করছি, সেসব বার্তা সব মানুষের কাছ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
আমাদের দেশের ডেইরি ইন্ডাস্ট্রিতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে সেটা আমাদের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু আমাদের ব্যবসা করে যেতে হবে। এখানে দুটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। একটি ইনপুট মার্কেটিং আর একটি আউটপুট মার্কেটিং। আমরা ইনপুট মার্কেট করতে পারলেও যখন আউটপুট মার্কেটিংয়ে যাই, মানে খামার থেকে ভোক্তাদের প্রোডাক্ট বিক্রি করতে আমাদের কিন্তু প্রচুর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। কারণ, আমরা এখনো ভোক্তাদের কাছে আমাদের ওপর আস্থা অর্জন করতে পারিনি। এইটার অনেক কারণ। কিছু অসাধু কারবারির জন্য সবার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলাও ঠিক না। আমাদের সবাইকে খেতে হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সকল পক্ষকে ধৈর্য ধরে এগুতে হবে। হুটহাট করে নেগেটিভ প্রচারণা সবার মাঝে বিভাজন তৈরি করে। খামারিদের প্রতি আস্থা রাখুন। ভুল হলে আলোচনা করে শুধরে দেবেন। আমাদের খামারিদের একটা সমস্যা হলো- যখন তারা একটি খামার শুরু করে তখন তারা প্রচুর পরিশ্রম করে। আর যখন দুই বা তিনটা ফ্লকে কিছু লাভের মুখ দেখে তখন আর খামারে সেইভাবে সময় দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না। তখন তারা মনে করে, আমি তো ব্যবসা শিখে গেছি। আসলে যত বছরই ব্যবসা করেন না কেন, আপনাকে খামারে যেতে হবে। আমাদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খামার ব্যবস্থাপনা শিখতে হবে আর প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিদিন এই সেক্টর পরিবর্তিত হচ্ছে। আপনাকেও সেই তালে শিখার চর্চা বাড়িয়ে দিতে হবে। ব্যবস্থাপনাই একটা খামারকে লাভজনক করতে যথেষ্ট। আর কোনো কারণে খামারির লস হলে ডিলারকে সে বাকি টাকা শোধ দিতে পারছে না। ডিলার টাকা না পেলে ফিড, চিকস্ কোম্পানি টাকা পাচ্ছে না। এখানে কিন্তু একটা চেইনের মতো কাজ করে। খেয়াল করে দেখুন কার লস বেশি হচ্ছে। নতুন উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলোÑ কেউ যদি খামার করতে চায় তাহলে সম্পূর্ণ আধুনিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে যাত্রা শুরু করুন। কমপক্ষে ছয় মাস লেখাপড়া করুন। জানুন, শিখুন, আলোচনা করুন। কারণ, ছোট খামারে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় রাখাটা কঠিন। বড় কোম্পানিগুলো যেভাবে খামার পরিচালনা করে ছোট খামারিদের পক্ষে কিন্তু সেভাবে চালানো সম্ভব না। একটা কোম্পানি যেভাবে প্রোডাক্টের কোয়ালিটি ঠিক রাখার জন্য টেকনোলজি ব্যবহার করে ছোট খামারির পক্ষে কিন্তু সেটা সম্ভব না। এসব কারণে তাদের উৎপাদন খরচও বেশি পড়ে। সেক্ষেত্রে ছোট কয়েকজন মিলে একটি বড় খামার করতে পারেন। অন্যথায়, বর্তমান বাজারে টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন। ডেইরি ও ক্যাটলের ক্ষেত্রেও একই পন্থা অবলম্বন করা উচিত। হুট করে না জেনেবুঝে বিনিয়োগ করলে হোঁচট খেতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদক ও প্রকাশক: জোনায়েদ মানসুর, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৫৬ পুরানা পল্টন, ঢাকা -১০০০। রেজিস্টার্ড : ২৯২ ভূইয়া পাড়া প্রধান সড়ক, খিলগাঁও, ঢাকা- ১২১৯। সম্পাদকীয়: ০১৭৮৯৪২১৪৪৪, বার্তাকক্ষ : ০১৯১৩৫৫৫৩৭১। ই-মেইল: inextpr@gmail.com , (বিজ্ঞাপন), newsuddokta@gmail.com (বার্তাকক্ষ)