480
ঢাকাবুধবার , ১৪ মে ২০২৫
  1. অনুসন্ধানী ও বিশেষ প্রতিবেদন
  2. অপরাধ-আইন ও আদালত
  3. অর্থনীতি
  4. আইটি, টেলিকম ও ই-কমার্স
  5. আবাসন-ভূমি-রাজউক-রিহ্যাব
  6. উদ্যোক্তা
  7. করপোরেট ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
  8. কৃষি, খাদ্য ও পরিবেশ
  9. গণমাধ্যম
  10. গৃহায়ন ও গণপূর্ত
  11. জনশক্তি ও পর্যটন
  12. জনসংযোগ-পদোন্নতি ও সম্মাননা
  13. জাতীয়
  14. ডিএস‌ই- সিএস‌ই-বিএস‌ইসি
  15. নগরজীবন
আজকের সর্বশেষ সবখবর

নগদের ২৩৫৬ কোটি টাকার জবাব নেই

https://www.uddoktabangladesh.com/wp-content/uploads/2024/03/aaaaaa.jpg
উদ্যোক্তা বাংলাদেশ ডেস্ক
মে ১৪, ২০২৫ ১১:৩৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

একটি অদৃশ্য কোম্পানি—যার চেয়ারম্যান পরিচয় জানেন না এমডিকে, আর এমডি চেনেন না চেয়ারম্যানকে। কোম্পানির কাগজে-কলমে ঠিকানা থাকলেও বাস্তবে নেই কোনো অফিস বা কার্যক্রম। এমনই এক ছায়া প্রতিষ্ঠানের নামে দেশের জনপ্রিয় মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ‘নগদ’ বিপুল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেছে দেশি-বিদেশি একাধিক ছদ্মবেশী কোম্পানিতে। তবে বিনিয়োগের সেই অর্থের একটি কড়িও আর দেশে ফেরেনি—সবই চলে গেছে তৃতীয় কোনো দেশে।

গত আট বছরে এভাবেই লাখো গ্রাহকের জমা রাখা শত শত কোটি টাকা নানা কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এই চক্রের নেপথ্যে ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ তাদের ঘনিষ্ঠ মহল। সংশ্লিষ্টতা রয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারও। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর একজন উপ প্রেস সচিবও এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।

অর্থ লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের কেউ কেউ এখনো বিভিন্ন প্রভাবশালী অবস্থানে রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান আইনি পদক্ষেপও দেখা যায়নি। বরং অনেকেই এখন ‘নগদকে পুনর্গঠনের’ নামে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন—যেন কিছুই হয়নি!

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগদের মালিকানা সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের নাকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেডের, এ নিয়ে দীর্ঘদিন কৌতূহল ছিল। সহসা এই সমস্যার জট খোলা যায়নি। কিন্তু ২০২১ সালের ১৬ই আগস্ট আন্তঃসংস্থার বৈঠকে নগদের মালিকানা বিরোধের অবসান হয়। তাও ছিল অস্পষ্ট। তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরই বেরিয়ে আসে নগদের আসল চিত্র। বেরিয়ে আসে নানা অনিয়মের তথ্য।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট দেখিয়ে ‘নগদ’ এ আর্থিক জালিয়াতি করা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক অর্থ বা ই-মানি। এসব কারণে অন্তত ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার হিসাব গড়মিল পাওয়া গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নগদের পরিচালনায় প্রশাসক ও ব্যবস্থাপনা কমিটি নিয়োগ দেয়। তাদের পরিদর্শনে এসব অনিয়মের চিত্র প্রকাশ পায়।

তদন্তে আরও জানা গেছে, নগদের শেয়ার লেনদেনেও রয়েছে বড় ধরনের অনিয়ম। এর সূচনা হয় ফিনটেক হোল্ডিংস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটি মূলত আর্থিক খাতে ডিজিটাল সেবা, পরামর্শ ও আউটসোর্সিং প্রদান করে। এই ফিনটেকে নগদ বিনিয়োগ করে ৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, যা তাদের মোট শেয়ারের ৩.২ শতাংশ।

জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও ফার্মসের নিবন্ধন দপ্তরের (আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী, ফিনটেক হোল্ডিংস লিমিটেড-এর ঠিকানা দেখানো হয়েছে বনানীর ৩৬, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের ডেল্টা ডালিয়া টাওয়ারে। তবে ১০ মে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনে ‘ফিনটেক’ নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই।এই ভবনেই রয়েছে নগদের মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)-এর প্রধান কার্যালয়। ভবনটির ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি সাত বছর ধরে এখানে কাজ করছেন, কিন্তু ফিনটেক হোল্ডিংস লিমিটেড নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম কখনো শোনেননি, এমনকি এ ভবনের কোথাও তাদের অফিসও নেই। তদন্তকারীদের ধারণা, এই অস্তিত্বহীন কোম্পানিতে বিনিয়োগ দেখিয়ে ‘নগদ’-এর বিপুল অর্থ ডিজিটাল গেটওয়ে ব্যবহার করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগদের ৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে ব্লু ওয়াটার হোল্ডিংস লিমিটেডের নামে। তবে আরজেএসসিতে (রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ) তাদের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে গুলশান-২, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ। অথচ কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ মূলত বনানীতে অবস্থিত, গুলশান-২-এ এমন কোনো ঠিকানা নেই। এই কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে দেখানো হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে ও শরীয়তপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি নাহিম রাজ্জাককে। তিনিই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ম্যানেজিং ডিরেক্টর) হিসেবেও তালিকাভুক্ত। নগদের আরেক শেয়ারহোল্ডার হলো তাসিয়া হোল্ডিংস লিমিটেড, যার শেয়ারের পরিমাণ ২.৪ শতাংশ। এর চেয়ারম্যান তানভির আহমেদ মিশুক, যিনি সাবেক পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের বন্ধু। ডিরেক্টর হিসেবে রয়েছেন রোকসানা কাশেম টুম্পা, যিনি ২,৫০০ শেয়ারের মালিক।

তাসিয়া হোল্ডিংস লিমিটেডের হেড অফিস রয়েছে বনানীর ডেল্টা ডালিয়া টাওয়ারে, যেখানে নগদ এমএফএস-এর মূল কার্যালয়ও অবস্থিত। ১০ মে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের দুই তলায় তাসিয়ার একটি ছোট অফিস রয়েছে, আনুমানিক ৫০০-৬০০ স্কয়ার ফিটের। সেখানে মাত্র দু’জন কর্মী বসে ছিলেন, বাকি ৩০-৪০টি চেয়ার খালি। ভবনের দারোয়ান জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এই অফিসে অনেক ভিড় ছিল, দলীয় নেতারাও যাতায়াত করতেন। তার ভাষায়, এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি কার্যত নিষ্ক্রিয়।

নগদ লিমিটেডের মোট সাধারণ শেয়ারের পরিমাণ ১৬ কোটি ৭৯ লাখ, যার আর্থিক মূল্য ১৬৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা (প্রতি শেয়ার ১০ টাকা)। দেশি ৫টি এবং বিদেশি ৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই শেয়ার বিভাজিত। দেশি ৫টি প্রতিষ্ঠানের মোট শেয়ার ২৯.১ শতাংশ। সেগুলো হলো: তাসিয়া হোল্ডিংস (২.৪%), ফিনটেক হোল্ডিংস (৩.২%), ব্লু ওয়াটার হোল্ডিংস (৬%), সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স (১৫.৩%) ও ইএসওপি হোল্ডিংস (২.২%)। বিদেশি ৫টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ৭০.৯ শতাংশ, যার মধ্যে বৃটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জভিত্তিক মিরেস হোল্ডিংস একাই মালিক ৭০.৫ শতাংশ শেয়ারের। বাকি চারটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার মিলিয়ে ১ শতাংশেরও কম। এ ছাড়া পছন্দনীয় শেয়ারধারী হিসেবে ৬টি কোম্পানি রয়েছে, যাদের শেয়ারের পরিমাণ ৮৮ লাখ টাকার। এদের মধ্যে তাসিয়া হোল্ডিংসের ৩০.৮%, সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্সের ৪২.৮% এবং মিরেস হোল্ডিংসের ২২.৬% রয়েছে। বাকি তিনটির মোট শেয়ার ৪.২ শতাংশ।

নগদের শেয়ার বণ্টনে অনিয়ম: ক্যান্ডেলস্টোন ইনভেস্টমেন্টস পার্টনার লিমিটেড একটি বাংলাদেশি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি। ২০২১ সালের ৭ জুলাই থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি নগদ লিমিটেডে মোট ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। এই অর্থ নগদের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং ওয়ান ব্যাংকের হিসাবে জমা করা হয়।

এই বিনিয়োগের বিপরীতে বিভিন্ন তারিখে ৪৫০ কোটি টাকার কমার্শিয়াল পেপার ইস্যু করা হয়, যার সুদের হার ছিল ৬ শতাংশ। বাকি ৫০ কোটি টাকার বিপরীতে ৬২ কোটি ১২ লাখ ২৫ হাজার ১৬০ টাকার অভিহিতমূল্যের সাধারণ শেয়ার ইস্যু করা হয়। পরবর্তীতে, ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর এই সম্পূর্ণ শেয়ার সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের অনুকূলে স্থানান্তর করা হয়।নগদের প্রশাসক কমিটির তদন্তে উঠে আসে, মাত্র এক বছরের মধ্যে এই ৫০০ কোটি টাকার অধিক বিনিয়োগ, কমার্শিয়াল পেপার ইস্যু এবং দ্রুত শেয়ার হস্তান্তরের পুরো প্রক্রিয়াটি সন্দেহজনক। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে এমন বড় অঙ্কের লেনদেনের পেছনে অসাধু উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ক্যান্ডেলস্টোন থেকে সিগমায় শেয়ার হস্তান্তরের রহস্য : ২০২০ সালের ৪ জুন সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল, সৈয়দ আরশাদ রেজা এবং মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের ১ লাখ ২৫ হাজার শেয়ার করে বাংলাদেশি কোম্পানি সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের জন্য মোট ৩ লাখ ৭৭ হাজার শেয়ার হস্তান্তর করেন। এরপর ২০২২ সালের ১০ মার্চ শেয়ার প্রিমিয়ামের বিপরীতে বোনাস শেয়ার ইস্যু করা হয়, যার ফলে সিগমা ৫৭ লাখ ৫০ হাজার ৯৩০টি সাধারণ শেয়ারের মালিকানা লাভ করে। ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর ক্যান্ডেলস্টোন ৬ কোটি ২১ লাখ ২২ হাজার ৫১৬টি সাধারণ শেয়ার সিগমার অনুকূলে হস্তান্তর করে।

এরপর, ২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি নগদ লিমিটেড সিগমা থেকে ২৫ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের চুক্তি করে, তবে মাত্র ছয়দিন পরে ২২ জানুয়ারি উক্ত চুক্তিটি সংশোধন হয়ে ঋণের সীমা ২৫ কোটি টাকার পরিবর্তে ৪০০ কোটি টাকায় পুনঃনির্ধারিত হয়। এতে উভয় ঋণের সুদসহ পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। এই সমস্ত ঘটনা থেকে নগদের জামানতের টাকা কারসাজির মাধ্যমে হারানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনিয়মের বিষয়ে মন্তব্য জানতে নগদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। সূত্র মানবজমিন