উদ্যোক্তা বাংলাদেশ ডেস্ক : সোনা পাচারও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই যাচ্ছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন এয়ারলাইনস ব্যবহার করে বাংলাদেশে আসছে সোনার চালান। চোরাচালানিরা শাহজালালসহ দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে নিয়মিত রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। নানা কৌশল নিয়েও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো পাচার রোধে সফল হতে পারছে না। ফলে উদ্বেগ বাড়ছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের।
সোনা পাচার রোধে শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক করছেন কর্তৃপক্ষ। গোয়েন্দা তদন্তে উঠে এসেছে, এ চোরাচালানে দেশি-বিদেশি একাধিক চক্র সক্রিয়ভাবে জড়িত। বেশিরভাগ সদস্য বিদেশে অবস্থান করলেও তাদের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশ, ভারত, দুবাই, পাকিস্তান, সৌদি আরব, চীন ও মালয়েশিয়াসহ অন্তত ১০টি দেশে। এমনকি কিছু মাফিয়া আন্ডারওয়ার্ল্ড সন্ত্রাসীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে। পুলিশ সদর দপ্তর ও শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ এ পর্যন্ত সোনা পাচারে জড়িত ২০৯ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছে, যা গত মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (প্রশাসন) রেজাউল করিম জানান, সোনা সহ সব ধরনের চোরাচালান রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরলসভাবে কাজ করছে। তিনি বলেন, দেশি বা বিদেশি—কোনো অপরাধীই ছাড় পাচ্ছে না। সারা দেশে পুলিশের নজরদারি জোরদার করা হয়েছে, বিশেষ করে বিমানবন্দরে চোরাকারবারিদের ধরতে পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। প্রস্তুত তালিকা অনুযায়ী অভিযান পরিচালিত হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
ঢাকা কাস্টম হাউজের কমিশনার মুহম্মদ জাকির হোসেন জানান, সোনা ও অন্যান্য অবৈধ পণ্যের চালান নিয়মিত ধরা পড়ছে, তাই নজরদারি আরও জোরদার করা হয়েছে। তিনি বলেন, সব কর্মকর্তাকে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যেন কোনোভাবেই অবৈধ পণ্য বাইরে যেতে না পারে। কাস্টমসের প্রতিটি টিম সর্বোচ্চ সতর্কতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। গোয়েন্দা সোর্স বাড়ানোর পাশাপাশি বিমানবন্দরে অন্যান্য সংস্থার সদস্যরাও সোনা পাচারকারীদের ধরতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
পাচারের পথ হিসেবে ব্যবহার : অনেক দিন ধরেই শাহজালাল, শাহ আমানত ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে ঘিরে নানা ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে একটি সক্রিয় চক্র। সংশ্লিষ্টরা জানান, নানা কৌশল প্রয়োগ করেও কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এসব অপরাধের মধ্যে সোনা পাচার সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক। আগের তুলনায় এখন সোনা পাচারের প্রবণতা অনেক বেড়েছে এবং প্রায় প্রতিদিনই সোনার চালান ধরা পড়ছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তদন্তে উঠে এসেছে, এই চোরাচালানে বিদেশি এজেন্টদের পাশাপাশি দেশীয় এজেন্টরাও সরাসরি জড়িয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের সঙ্গে গড়ে উঠেছে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ হয়ে পাচার হচ্ছে বিপুল পরিমাণ সোনা।
পুলিশ ও কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুল্ক ফাঁকির এমন অভিনব কৌশল আগে খুব একটা দেখা যায়নি। আগে যেখানে লাগেজ, শরীর বা ফ্লাইটের সিটে সোনা পাচার করা হতো, এখন পাচারকারীরা রোগী সেজে বা সোনা গুঁড়ো করে ভিন্ন পদার্থের নাম দিয়ে তা পার করার চেষ্টা করছে। তবে তাদের এসব কৌশল ঠেকাতে নজরদারি বহুগুণে বাড়ানো হয়েছে। কর্মকর্তারা বলেন, আন্তর্জাতিক চক্রগুলো বাংলাদেশকে সোনা পাচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করছে।
আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের নাম : পুলিশ ও শুল্ক গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েক বছর আগে ১২ কোটি টাকা মূল্যের সোনাসহ ধরা পড়েন জাপানি নাগরিক তাকিও মিমুরা ও চীনা নাগরিক জু জিয়াং। তবে তারা জামিন নিয়ে বেরিয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন এবং তারা আবারও একই কারবার চালাচ্ছেন। তারা কলকাতার আমির খানের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সোনা পাচারে ব্যস্ত। আমির খানও বাংলাদেশ পুলিশের কাছে ধরা পড়েছিলেন। বলা হয়েছে, ভারতের ঈশ্বর দাস, সৌরভ ম-ল, রমেশ কুমার ভার্মা, সালেকিন শেখ, সৌমিক দত্ত, কুলদীপ সিং, ওয়াসিম, দুবাইয়ের রমজান আলী, পাকিস্তানের আরশাদ আয়াজ আহমেদ, ভারতের গুজরাট সিং, প্রকাশ, রেখা, উর্মিলা কুমার, অনিক কুমার, বিনোদ কুমার, গুরজন্ত সিং, বিজয় কুমার, দিনেশ, পাকিস্তানের রাশেদ মো. খালেদ।
এছাড়া রয়েছে, চীনের চেন সিম ফাত, চেন জিলা, দিং শোশেং, জু ইয়ংগাং, লুতেংচেং, জাপানের শুইচি সাতো, মালয়েশিয়ার চ্যান গি কিউনগ, রাজা বসলিনা বিনতি, ক্যামেরুনের নোগোমবি বাছি, নাইজেরিয়ার নন্দিকা ক্লিনেন্ট, ক্লেটাস আছুনা, ওইউকুলভ টিমটি, একিন উইসডোম, দক্ষিণ আফ্রিকার চিগোজি, ইভুন্ডে গ্যাব্রিল ওবিনা, স্যালেস্টাইন প্যাট্রিক, মর্দি ন্যামডি, ওরদু চুকওরদু সাম্মি, ডুবুওকন সোমায়ইনা, জেয়েরেম প্রেসিয়াস, দিনাজুপুরের সোহেল রানা, নরসিংদীর মনির আহম্মেদ, নারায়ণগঞ্জের ওয়ায়েদউল্লাহ, মিরপুরের সাইফুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জের মঞ্জুর হোসেন, পল্লবীর সামসুল হুদা, মুন্সীগঞ্জের ইসলাম শেখ, রাজবাড়ির মোহাম্মদ হানিফ, মুন্সীগঞ্জের মোহাম্মদ রুবেল, ভারতের রূপসাহা, গোপাল বিজন, বিজন হালদার, লক্ষণ সেন, গোবিন্দ বাবু, লালু জয়দেব, গওহর প্রসাদ, সঞ্জিব, রামপ্রসাদ, মিন্টু, সুমন চ্যাটার্জী, রিয়াজ, তপন সাহা, ডালিম, মোনায়েম, ফারুক, বসাক চ্যাটার্জী ও স্বপন সাহাসহ ২০৯ জনের সিন্ডিকেট সোনা পাচারে জড়িত।
সব বিমানবন্দরেই সিন্ডিকেট : সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই সিন্ডিকেটগুলো শাহজালাল, শাহ আমানত ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সোনার চালান পাচার করছে। ওইসব জায়গায় তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে জুয়েলারি দোকানের কিছু মালিকেরও। রাজনৈতিক কানেকশনও আছে। বিমান ও সিভিল অ্যাভিয়েশনের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীও চোরাকারবারিদের সহায়তা করছে। প্রকৃত চোরাকারবারিদের ধারে-কাছেও ভিড়তে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। ফলে বড় চালান ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
এয়ারলাইনস কর্মকর্তাদের কার্যক্রমে গোয়েন্দা নজরদারি : দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনসের মাধ্যমে সোনা পাচার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। এই পাচারের সঙ্গে কেবিন ক্রু থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারীরাও জড়িত। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তার হওয়া কেবিন ক্রু রোকেয়া শেখ মৌসুমী দীর্ঘদিন ধরে সোনা পাচার করে আসছে এবং তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সৌদি এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রু ফারজানা আফরোজ ও সায়মা আক্তারও একই কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে।
তারা বিদেশ থেকে আসার পর লাগেজ কিংবা শরীর তল্লাশি না হওয়ার সুযোগ নিয়ে এসব অপরাধ করছে। অন্যান্য কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরাও এসব অপকর্মে জড়িত বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে এবং তাদের তালিকা তৈরি করে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ, ভারত, সিঙ্গাপুর, হংকং, মালয়েশিয়া, দুবাইসহ কয়েকটি দেশে সোনা পাচারের সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশি সদস্যও রয়েছে।