ব্যাংকে ঋণের আবেদন করার আগেই গ্রাহকের হিসাবে টাকা ছাড় করার ঘটনা সামনে এসেছে। এমনকি গ্রাহক নিজে ঋণের হিসাব খোলেননি, তবুও ব্যাংক থেকে নগদ অর্থ তুলে দেওয়া হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদে ঋণের অনুমোদন দেওয়ার আগেই টাকা বিতরণ করা হয়েছে। চেক ছাড়াই মাত্র একটি স্লিপের ভিত্তিতে গ্রাহকের প্রতিনিধির হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বস্তাভর্তি করে এসব টাকা নিয়ে গেছেন।
গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন ঋণ জালিয়াতির এসব ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে। এস আলম, বেক্সিমকো ও নাবিল গ্রুপসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান এতে জড়িত। গ্রুপগুলো বাসার কাজের লোক, গাড়ির চালক ও কোম্পানির কর্মীদের পরিচালক বানিয়ে তাদের নামে কোম্পানি নিবন্ধন করিয়েছে। এরপর সেই নামেই ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এমনকি অস্তিত্বহীন কোম্পানির নামেও হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে নিজ নামে ও বেনামে নেওয়া এসব ঋণের অর্থ পরে পাচার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) এখন পর্যন্ত পরিচালিত তদন্তের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনে এসব চাঞ্চল্যকর ও ভয়ানক তথ্য ওঠে এসছে। তদন্ত এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে জালিয়াতির নতুন নতুন ধরন উদ্ঘাটিত হচ্ছে। এসব অনিয়ম কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেমন এড়িয়ে গেছে, তেমনি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারাও সংশ্লিষ্ট আইন প্রতিপালন করেননি। গ্রাহক নিজে নিয়মের বাইরে থেকে ঋণ নিয়েছেন। কোনো পক্ষই আইনের মধ্যে আসেনি। উল্লিখিত তিনটি গ্রুপের মোট ঋণের হিসাব নিয়েও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে তাদের ঋণের যে তথ্য দেওয়া হয়েছে বর্তমান সরকারের হিসাবের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। তাদের ঋণের পরিমাণ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। যা আগে পোগন রাখা হয়েছিল।
সূত্র জানায়, ঋণ নেওয়ার আগে গ্রাহককে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শাখায় আবেদন করতে হবে। শাখা থেকে আবেদন পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই করে আঞ্চলিক অফিস বা প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়ে থাকে। তারা যেটি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পাঠাবে ব্যাংকের ক্রেডিট কমিটিতে। কমিটি অনুমোদন করলে তা পাঠানো হবে পরিচালনা পর্ষদে। পর্ষদ অনুমোদন করলেই শর্ত মোতাবেক ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে। তার আগে গ্রাহককে যে কোম্পানির নামে ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে তার নামে হিসাব খুলতে হবে। সে হিসাবে ব্যাংক পর্ষদের অনুমোদনের শর্ত অনুযায়ী ঋণ ছাড় করবে। জনতা ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের একটি ঋণের ক্ষেত্রে আলোচ্য কোনো নিয়ম-কানুনই মানা হয়নি। এমন কি গ্রাহক ঋণের জন্য আবেদনই করেননি। সালমান এফ রহমানের মুখের কথায় জনতা ব্যাংকের হিসাব থেকে ঋণের টাকা গ্রাহককে নগদ আকারে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে জগাখিচুড়ির মাধ্যমে ঋণের কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে।
এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক দখলের পর ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখা থেকে পানির মতো ঋণ নিয়েছে। এক্ষত্রে কোনো নিয়মকানুন মানা হয়নি। ঋণের আবেদন পর্যন্ত অনুমোদন করেনি। এমন কি ক্রেডিট কমিটিও সেটি পর্যালোচনা করেনি। কিন্তু গ্রাহকের হিসাবে ঋণের টাকা ছাড় হয়ে গেছে। পরে ঋণটি খেলাপি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করে কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব পায়নি।ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হলে চেক বা ভাউচার লাগবে। কিন্তু এসব ছাড়াই এস আলমের নির্দেশে শুধু একটি স্লিপ লিখে ব্যাংক থেকে গ্রাহককে নগদ আকারে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এভাবে টাকা দেওয়ার কোনো বিধান নেই। ব্যাংক মোটা অঙ্কের টাকা নগদ আকারে দিতে পারে না। চেক বা ড্রাফট আকারে দেবে বা গ্রাহকরে কাঙ্ক্ষিত হিসাবে স্থানান্তর করে দেবে।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী বেনামি হিসাব খোলা, বেনামি কোম্পানি খোলার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু নাবিল গ্রুপ বেনামি কোম্পানি ও বেনামি ব্যাংক হিসাব খুলেছে। ওই হিসাবে ব্যাংকের সঙ্গে টাকার লেনদেন করেছে। এক্ষেত্রে দুই পক্ষই মানি লন্ডারিং অপরাধ করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। ইসলামী ব্যাংকের কয়েকটি শাখা থেকে ব্যাংকটি এসব ঋণ নিয়েছে।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বেক্সিমকো গ্রুপের মোট ঋণের স্থিতি ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পরিচালিত তাৎক্ষণিক তদন্তে দেখা যায়, এ গ্রুপের ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। সাম্প্রতিক তদন্তে এই পরিমাণ আরও বেড়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা হয়েছে, এবং আরও বেনামি ঋণের তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে, যা মোট ঋণের পরিমাণকে ৬০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ছাড়িয়ে নিতে পারে।
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বেক্সিমকো গ্রুপের নামে কোনো ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। যদিও অনেক ঋণ পরিশোধের অনুপযুক্ত ছিল, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সেগুলো খেলাপি হিসেবে গণ্য করা হয়নি। তবে চলমান তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, যা বর্তমানে ৫৩ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। ঋণের অর্থ পাচারের যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর অনেক অংশও এখন খেলাপি ঋণের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে।
জনতা ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় থেকেই বেক্সিমকো গ্রুপ এখন পর্যন্ত ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। তদন্তে আরও বেনামি ঋণের তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে, যার ফলে মোট ঋণের পরিমাণ আরও বাড়ছে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সময় থেকেই বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। তার আমলে ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব এবং ঋণ ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার কারণে সহজেই নিয়মবহির্ভূত ঋণ অনুমোদিত হতো।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা করা হয়। রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে থাকেন। ২০১৬ সালে ফজলে কবির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করলেও অনিয়ম রোধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেননি; বরং এই জালিয়াতি চক্রের কার্যক্রমকে আরও সহায়তা করেছেন। এর ফলে সালমান এফ রহমান ও এস আলমের মতো ব্যক্তিরা আরও নির্ভয়ে ঋণ নিতে থাকেন। ২০২২ সালের পর থেকে এই অনিয়ম আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে, যার ফলে ঋণের পরিমাণও দ্রুত বাড়তে থাকে।
সূত্র জানায়, ফজলে কবিরের সময়ে ঢাকার বাইরে থেকে বদলি হয়ে আসা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বিধিসম্মত হয়নি বলে একটি কোম্পানির ঋণের ফাইল আটকে দেন। এটি ছিল বেক্সিমকো গ্রুপের বেনামি প্রতিষ্ঠান। তিনি জানতেন না এটি বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। পরে সালমান এফ রহমান গভর্নরের কাছে নালিশ করেন। গভর্নরের হস্তক্ষেপে বেনামি কোম্পানির ঋণটি ছাড়ের অনুমোদন দেওয়া হয় বেআইনিভাবে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেনামি ঋণ ছাড়ের অনুমোদন দিতে পারে না। বরং ঋণ আটকে দিতে পারে।
ওই সময় জানা যায়, একজন ডেপুটি গভর্নর বেক্সিমকো গ্রুপের বেনামি কোম্পানির একটি তালিকা রাখতেন। ওই তালিকার কোনো কোম্পানির ঋণ অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এলে তা দ্রুত ছাড় করা হতো। কিন্তু বেনামি ঋণের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নিত না। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও কোনো ব্যবস্থা নিত না। এতে বেক্সিমকো গ্রুপ বাধাহীনভাবে বেনামি ঋণ নিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এস আলম গ্রুপের ঋণের স্থিতি ৩০ হাজার কোটি টাকা। সরকারের পতনের পর তদন্ত শুরু হলে প্রথমে জানা যায় ঋণের স্থিতি ৫০ হাজার কোটি টাকা। পরে তদন্ত আরও এগোলে জানা যায় ঋণের স্থিতি ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এভাবে তদন্ত এগোতে থাকায় এখন পর্যন্ত জানা যাচ্ছে এস আলম গ্রুপের ঋণের স্থিতি ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এসব অর্থের বড় অংশই তিনি বিদেশে পাচার করেছেন। তবে পাচার করা অর্থ তার নিয়ন্ত্রণে নেই। ওই সব অর্থ চলে গেছে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠদের নিয়ন্ত্রণে।
এস আলমের নির্দেশে নাবিল গ্রুপকে কোনো নথিপত্র ছাড়াই শুধু মৌখিক কথার ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা দেওয়া হয়েছে। যা পুরোপুরি বেআইনি। পাশাপাশি এস আলম গ্রুপ নিজেও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ঋণে টাকা নিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে পণ্য আমদানির এলসি খুলেছে। কিন্তু সেই অর্থে তিনি পণ্য দেশে আনেননি। অর্থাৎ ওই টাকা পাচার করা হয়েছে। ফলে ইসলামী ব্যাংক ফোর্স লোন সৃষ্টি করে গ্রাহকের দায় শোধ করেছে। এখন পুরো টাকাই ইসলামী ব্যাংকের গচ্চা গেছে। এখন ব্যাংক ঋণকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
নাবিল গ্রুপের ঋণের পরিমাণ আগে তুলনামূলক কম ছিল, তবে ২০২২ সালের পর তা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। মূলত এস আলম নিয়ন্ত্রিত তিনটি ব্যাংক—ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে গ্রুপটি অধিকাংশ ঋণ গ্রহণ করেছে। এসব ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে, পাশাপাশি বিধিবিধান লঙ্ঘন করে বেনামে ঋণও নেওয়া হয়েছে।একসময় নাবিল গ্রুপের মোট ঋণের পরিমাণ হাজার কোটি টাকার নিচে থাকলেও বর্তমানে তা বেড়ে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। অথচ গ্রুপটির নিজস্ব সম্পদের পরিমাণ এত বড় ঋণ সামলানোর মতো নয়। অন্যদিকে, নাবিল গ্রুপের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, এস আলম গ্রুপ তাদের নামে ঋণ তুলে সেই অর্থ আত্মসাৎ করেছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: জোনায়েদ মানসুর, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৫৬ পুরানা পল্টন, ঢাকা -১০০০। রেজিস্টার্ড : ২৯২ ভূইয়া পাড়া প্রধান সড়ক, খিলগাঁও, ঢাকা- ১২১৯। সম্পাদকীয়: ০১৭৮৯৪২১৪৪৪, বার্তাকক্ষ : ০১৯১৩৫৫৫৩৭১। ই-মেইল: inextpr@gmail.com , (বিজ্ঞাপন), newsuddokta@gmail.com (বার্তাকক্ষ)