ব্যাংক এশিয়ার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউজ্জামান। একের পর এক অভিনব ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামানোর অভিযোগ রয়েছে তার নামে। দুর্নীতি-অনিয়ম করে হাতেনাতে ধরা পড়ার পরও তিনি রয়েছেন শাস্তির বাইরে। শুধু তা-ই নয়, এবার পেতে যাচ্ছেন বড় পুরস্কার।
ইসলামী ব্যাংকিং নীতিমালা পাস কাটিয়ে শরিয়াহভিত্তিক সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন তিনি। ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে আবদ্ধ এই বিতর্কিত কর্মকর্তাকে এমডি পদে নিয়োগ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন জানিয়েছে এসআইবিএলের পরিচালনা পর্ষদ। নীতিমালার পরিপন্থি এই নিয়োগ অনুমোদন নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের এমডি হওয়ার ক্ষেত্রে কমপক্ষে তিন বছর যেকোনো ইসলামী ব্যাংকে চাকরি করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ইসলামী ব্যাংকিং নীতিমালায় এ শর্তটির সুস্পষ্ট উল্লেখ ও ব্যাখ্যা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিপার্টমেন্টের (বিআরপিডি) একজন সাবেক পরিচালকও আছেন এসআইবিএলের পর্ষদে। তবুও সেই পর্ষদের এমন অভিনব আবেদনে বিস্ময় ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে।
জানা গেছে, গত ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে নিয়োগ অনুমোদন পেতে আবেদন করেছিল এসআইবিএল। তবে এখনও অনুমোদন না দেওয়ায় জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের সাবেক পরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংক নিযুক্ত এসআইবিএলের স্বতন্ত্র পরিচালক মাকসুদা বেগম।
জানতে চাইলে মাকসুদা বেগম বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংক নীতিমালা কোনো আইন নয়। ইসলামী ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও আমরা শফিউজ্জামানকে নিয়োগের সুপারিশ করেছি। কারণ এই মুহূর্তে ভালো কোনো কর্মকর্তা পাওয়া যাচ্ছে না। এসআইবিএলে নতুন শরিয়াহ বোর্ড গঠন হয়েছে। তারা নতুন এমডিকে সহযোগিতা করবে। তা ছাড়া বিভিন্নভাবে খোঁজখবর নিয়ে আমরা তার বিষয়ে ইতিবাচক তথ্য পেয়েছি। তবে দুদকের তদন্ত কিংবা গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঋণ জালিয়াতি সম্পর্কে আমরা অবগত ছিলাম না।’
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাকসুদা বেগমের এই ব্যাখ্যা নাকচ করে দিয়েছেন। একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো ইসলামী ব্যাংকিং নীতিমালার আলোকেই পরিচালিত হয়। এটি আইন না হলেও অন্য নীতিমালার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্য পালনীয়। কারণ দেশে ইসলামী ব্যাংকিং আইন নেই, তাই নীতিমালাটিই আইনের মতো কাজ করে। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব নীতিমালার পরিপন্থি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে গভর্নর যদি তার বিশেষ ক্ষমতায় কাউকে নিয়োগ দেন, তাহলে নীতিমালা কার্যকর না-ও হতে পারে। কিন্তু এসআইবিএলের বোর্ডে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডির একজন সাবেক পরিচালক থাকার পরও এ ধরনের আবেদন বিস্ময়কর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জানতে পেরেছি, ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অভিজ্ঞতা না থাকার পরও আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ব্যাংকটির পক্ষ থেকে একজনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে; যা বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে।’
মেসার্স এস এন ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস-এর মালিক মোহাম্মাদ শাহ আলম। তিনি ব্যাংক এশিয়ার জুরাইন শাখার একজন গ্রাহক। এই প্রতিষ্ঠানটি হজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত এবং হজ গমনেচ্ছুদের কাছে উড়োজাহাজের টিকিট বিক্রিসহ বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকেন। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালে প্রায় এক হাজার ব্যক্তিকে হজে পাঠানোর কথা বলে প্রায় ৫০ কোটি টাকা নেয়। তবে কাউকে হজে না পাঠিয়ে দেশত্যাগ করেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক শাহ আলম। তিনি শুধু হজে গমনপ্রত্যাশীদের টাকাই গায়েব করেননি, ব্যাংক এশিয়ারও সাড়ে ৪ কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন। ঋণ নিয়েছেন ভুয়া জামানতে। ব্যাংকটি এখন ঋণ ফেরত পাচ্ছে না। আবার জামানতও বেহাত হয়ে গেছে।
বিষয়টি তদন্তের জন্য ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুদকে একটি অভিযোগ দাখিল হয়। অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদক বর্তমানে তদন্তকাজ চালাচ্ছে। অভিযোগপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্যাংক এশিয়ার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচাক ও মুখ্য ঋণ কর্মকর্তা শফিউজ্জামান প্রতিষ্ঠানটিকে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ অনুমোদন করেন। ঋণের বার্ষিক সুদ ধরা হয় ৯ শতাংশ। অথচ হজ প্যাকেজে সুদভিত্তিক এ ধরনের ঋণ বিতরণে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ছিল। ব্যবসায়িক খরচ মেটাতে ১২০ দিনের জন্য চলতি হিসাবে (নং-১৫৫৩৩০০০৮৬৩) ৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ঋণের জামানত রাখা হয়। এই জামানতে ব্লক (স্থগিত) রাখার শর্ত আরোপ করা হয়। তবে পরে জালিয়াতির লক্ষ্যে চলতি হিসাবের পরিবর্তে গ্রাহকের এসএনডি হিসাব (নং ১৫৫৩৬০০০০৬৩) ব্লক রাখার শর্ত আরোপ করা হয়। মূলত শফিউজ্জামানের সঙ্গে গ্রাহক শাহ আলমের যোগসাজশেই জামানত পরিবর্তন করা হয়।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি হজযাত্রীর অনুকূলে ২ লাখ টাকা একটি এসএনডি হিসাবে জমা রেখে তা ব্লক রাখতে হয়। অভিনব জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক এশিয়া থেকে সাড়ে ৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ওই টাকা এসএনডি হিসাবে রাখা হয়। নিয়ম অনুযায়ী হিসাবটি ব্লকও করা হয়। অপরদিকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশে ব্লক করা হিসাবটি ব্যাংকঋণের জামানত হিসাবেও রাখা হয়। অর্থাৎ ঋণের টাকায় জামানত পূর্ণ করা হয়। অথচ এই জামানতটি ছিল ভুয়া, যা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পাওনা টাকা। পরে নিয়ম অনুযায়ী এই হিসাব থেকে টাকা কেটে নেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়। ফলে ব্যাংকের ঋণ ও জামানত সবই হাতছাড়া হয়ে যায়। ঋণগ্রহীতা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকের পুরো ঋণটি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
জানা গেছে, শাখা কর্মকর্তাদের তীব্র আপত্তির পরও শফিউজ্জামানের নির্দেশনায় তার অধীনস্ত কর্মকর্তা তাহমিদ রশীদ (হেড অব রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগ) এবং মুরাদ মোহাম্মাদ (ডেপুটি হেড অব রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগ) ঋণটি অনুমোদন করেন। এমনকি ঋণটি মঞ্জুর করার সময় প্রধান কার্যালয়ের ঋণ সভাতেও উত্থাপন এবং অনুমোদন করা হয়নি। বিজনেস ডিপার্টমেন্টের অনুমোদন ছাড়াই শফিউজ্জামানের একক ক্ষমতায় ঋণটি ছাড় করা হয়। জালিয়াতি ধরা পড়ার ভয়ে গোপনে ঋণটি অনুমোদন ও ছাড় করেন শফিউজ্জামান।
ব্যাংক সূত্রের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এ ঘটনার তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে চিঠি দেন দুদকের অভিযোগ সেলের পরিচালক উত্তম কুমার মন্ডল। এছাড়া ঘটনাটি তদন্তের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ। ২০২৩ সালের ৩ আগস্ট চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল জানায়, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিতরণকৃত ঋণটি তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত পরিচালনা করে ব্যাংক এশিয়া। তদন্তে অভিযোগের চেয়েও বড় জালিয়াতি ধরা পড়ে। হ্জ প্যাকেজের আওতায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার ঋণ বিতরণের অভিযোগ থাকলেও তদন্তে দেখা যায় মাত্র ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা জামানত রেখে ৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা ঋণ বাগিয়ে নিয়েছে শাহ আলমের এস এন ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরস কোম্পানি এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এভিয়ানা ট্রাভেলস। এতে জামানত ঘাটতির কারণে ব্যাংকটির ৭ কোটি ৬০ লাখ টাকারও বেশি ঋণ ঝুঁকিতে পড়ে যায়।
অভিযোগ- তদন্ত প্রতিবেদনটি ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ এবং বোর্ড সেক্রেটারিয়েটে জমা পড়লেও ক্ষমতার দাপটে ধামাচাপা দেন শফিউজ্জামান। তবে এ ঘটনায় চাকরিচ্যুত হয়েছেন ব্যাংক এশিয়ার সংশ্লিষ্ট শাখা ব্যবস্থাপক হাসান আলী গাজী। তিনি বলেন, ‘তদন্তে মোট ৯ জনকে দায়ী করা হয়েছিল। সেখানে মুখ্য ঋণ কর্মকর্তা হিসেবে শফিউজ্জামানের নামও ছিল। কিন্তু রহস্যজনকভাবে শুধু আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, বাকি সবাই বহাল আছেন।’
লবিস্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঘুষ নেন শফিউজ্জামান: পর্যাপ্ত জামানত না থাকলেও লবিস্ট নিয়োগ করে ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকা ঋণ দেন শফিউজ্জামান। কমিশনবাণিজ্য চলে কনসালট্যান্সি ফার্মের আড়ালে। নিজের ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয় ইনস্পিরিগেন্স সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএসএল) নামের এই লবিস্ট প্রতিষ্ঠান। দেড় থেকে দুই শতাংশ কমিশনের শর্তে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার চুক্তি করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি। ১০০ টাকার সরকারি স্ট্যাম্পে এলিট পেইন্ট অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা এমন একটি চুক্তিপত্র উদ্যোক্তা বাংলাদেশের হাতে এসেছে।
এতে দেখা যায়, প্রথম ৫০ কোটিতে দুই শতাংশ হারে কমিশন এবং এর বেশি পরিমাণের ক্ষেত্রে দেড় শতাংশ হারে কমিশনের শর্তে চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ব্যাংক এশিয়া থেকে এলিট পেইন্টকে ঋণ পাইয়ে দিতে তদবির করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি। আপন ভাই ব্যাংক এশিয়ার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউজ্জামানের মাধ্যমে ১৪০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করিয়ে নেন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির (আইএসএল) এমডি মাহবুবুজ্জামান। শর্ত অনুযায়ী, ২ কোটি ৯ লাখ টাকা কমিশন ভাগাভাগি করেন দুই ভাই। মাহবুবুজ্জামানের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে প্রথম দফায় ৩০ লাখ টাকা ও দ্বিতীয় দফায় ১৫ লাখ টাকা লেনদেন হয়। বাকি ১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা নগদে লেনদেন হয়েছে।
ঋণের নথিপত্র বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ব্যাংক এশিয়ার উত্তরা শাখায় এলিট পেইন্ট অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি প্রতিষ্ঠান ঋণের জন্য আবেদন করেছে। ঋণের অঙ্ক প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। তবে প্রতিষ্ঠানটি তাদের যোগ্যতা অনুসারে ঋণ না পাওয়ায় অসৎ উপায় অবলম্বন করে। এক্ষেত্রে সহায়তা করেন শফিউজ্জামান ও মাহবুবুজ্জামান ভ্রাতৃদ্বয়।
জানতে চাইলে অভিযুক্ত শফিউজ্জামান বলেন, ‘এগুলো ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করব না।’