এস আলম গ্রুপের অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান মুরাদ এন্টারপ্রাইজের নামে ভুয়া কাগজপত্রে এক হাজার ৯২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ঋণ দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ উঠেছে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের (আইবিবিএল) সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলমের নির্দেশে এ ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের ৩৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী।
মামলার বিবরণীতে বলা হয়েছে, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ছেলে এবং আইবিবিএলের সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলমের নেতৃত্বে শুধুমাত্র ব্যাংকটির চট্টগ্রামের চাকতাই শাখা থেকেই লুটপাট হয়েছে এক হাজার ৯২ কোটি টাকা। দূর-সম্পর্কের খালাতো ভাই ও এস আলম গ্রুপের বেতনভুক্ত কর্মচারী, মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী গোলাম সারওয়ার চৌধুরীকে সামনে রেখে মাত্র তিন বছরে ওই টাকা হাতিয়ে নেয় আলোচিত গ্রুপটি।
এ কাজে গ্রুপটিকে সহযোগিতা করেছে ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন এমডি ও পরিচালকসহ ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ৩৪ কর্মকর্তা। এসব কর্মকর্তার পাশাপাশি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ মিলিয়ে মোট ৫৮ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ পায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান টিম। এরপর অনুসন্ধান টিম কমিশনে প্রতিবেদন দেয় ও মামলার সুপারিশ করে। অনুসন্ধান টিমের মামলা দায়েরের সুপারিশের পর গতকাল বৃহস্পতিবার এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলমসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। দুদকের উপ-পরিচালক ইয়াছির আরাফাত বাদী হয়ে চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে এ মামলা করেন।
দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘অনুসন্ধান টিমের সুপারিশের প্রেক্ষিতে কমিশন থেকে মামলা দায়েরের অনুমোদনের পর মামলা হয়েছে। যেখানে আইবিবিএলের সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলমকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। পাশাপাশি তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান, এমডি ও একাধিক পরিচালকসহ ৫৮ জনকে আসামি করা হয়েছে।’
দুদকের অনুসন্ধান টিমের সুপারিশের ভিত্তিতে যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন- ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলম, সাবেক পরিচালক ও ইসি কমিটির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ডা. তানভীর আহমদ, ব্যাংকটির সাবেক পরিচালক ড. মো. ফসিউল আলম, কাজী শহীদুল আলম, ড. মো. সিরাজুল করিম, জামাল মোস্তফা চৌধুরী, মো. জয়নাল আবেদীন, সাবেক পরিচালক খুরশীদ উল আলম, সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক ড. মোহাম্মদ সালেহ জহুর ও মোহাম্মদ সোলায়মান, পরিচালক মো. কামরুল হাসান ও সাবেক নমিনী পরিচালক সৈয়দ আবু আসাদ।
এ ছাড়া আসামি করা হয়েছে- ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ কায়সার আলী ও কে কিউ এম হাবিবুল্লাহ, ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি ও চিফ হিউম্যান রিসার্চ অফিসার মো. মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী, মিফতাহ উদ্দিন, মোহাম্মদ আলী ও মোহাম্মদ সাব্বির, সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. রেজাউল করিম, বর্তমান উপব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম, সাবেক এসইভিপি ও এএমডি মো. আলতাফ হোসেন, এসইভিপি জি এম মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন কাদের, আবু ছাঈদ মুহাম্মদ ইদ্রিস ও সাবেক এসইভিপি মোহাম্মদ উল্লাহ, ব্যাংকটির বিনিয়োগ প্রশাসন বিভাগের প্রধান ও এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. ফরিদ উদ্দিন, ইসলামী ব্যাংকের কক্সবাজার শাখার ম্যানেজার আমান উল্লাহ, চট্টগ্রামের চাকতাই শাখার সাবেক ম্যানেজার ও বর্তমানের এফএভিপি মোহাম্মদ আলী আজগর, চাকতাই শাখার সাবেক বিনিয়োগ ইনচার্জ খাজা মোহাম্মদ খালেদ, চাকতাই শাখা প্রধান ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. মনজুর হাসান, ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জোনের প্রধান মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী এবং দক্ষিণের অপর জোনপ্রধান ও এসইভিপি মিয়া মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ।
ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে আসামির মধ্যে রয়েছেন- মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ গোলাম সারওয়ার চৌধুরী, চৌধুরী অ্যান্ড হোসাইন ট্রেড লিংকের মালিক মোহাম্মদ এরশাদ হোসাইন চৌধুরী, বিসমিল্লাহ ট্রেডিং করপোরেশানের মালিক মোরশেদুল আলম, মেসার্স ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, চেমন ইস্পাত লিমিটেডের পরিচালক মুহা. নজরুল ইসলাম, ওই প্রতিষ্ঠানের এমডি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরিফুল ইসলাম চৌধুরী, পরিচালক মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান, রেইনবো করপোরেশনের মালিক রায়হান মাহমুদ চৌধুরী, আনছার এন্টারপ্রাইজের মালিক আনছারুল আলম চৌধুরী, সোনালী ট্রেডার্সের মালিক সহিদুল আলম, ফেমাস ট্রেডিং করপোরেশনের মালিক আরশাদুর রহমান চৌধুরী, গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশনের এমডি মো. রাশেদুল আলম, পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুস সবুর, গ্রিন এক্সপোজ ট্রেডার্সের মালিক এম এ মোনায়েম, কোস্টলাইন ট্রেডিং হাউজের মালিক এরশাদ উদ্দিন, জাস্ট রাইট ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. গিয়াস উদ্দিন, এক্সক্লুসিভ বিজনেস হাউজের মালিক ফেরদৌস আহম্মদ বাপ্পি, এনেক্স বিজনেস কর্নারের মালিক আনোয়ারুল আজম, সেন্ট্রাল পার্ক ট্রেডিং হাউজের মালিক মোহাম্মদ মঞ্জুর আলম, জুপিটার ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক মোহাম্মদ মামুন, চৌধুরী বিজনেস হাউজের মালিক মোহাম্মদ রাসেল চৌধুরী, ডিলাক্সিয়াম ট্রেডিং করপোরেশনের মালিক কাজী মেজবাহ উদ্দিন, সোশ্যাল ট্রেড সেন্টারের মালিক আলী জহুর এবং শাহ আমানত ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী চৌধুরী।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০২১ সালে নভেম্বর মাসে এস আলম সংশ্লিষ্ট মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম সারওয়ার চৌধুরী ইসলামী ব্যাংকের চাকতাই শাখায় ঋণের জন্য আবেদন করেন। পরের মাসে ওই শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই না করে তা অনুমোদন করেন। মিথ্যা তথ্যের ওপর জাল কাগজ তৈরি করে এই ঋণের জন্য আবেদন করে মুরাদ এন্টারপ্রাইজ। প্রথমে ৮৯০ কোটি টাকা ঋণের জন্য আবেদন করা হলেও পরে সেটা ১ হাজার ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। যার মধ্যে আসল ৯৬৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ও মুনাফা ১২৫.৮০ কোটি টাকাসহ ১ হাজার ৯২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে। যে কারণে ৫৬ আসামির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/৪৭৭ক/১০৯ ধারা ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১- এর ৪(২) এবং ৪(৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, মুরাদ এন্টারপ্রাইজ যে বিনিয়োগের কথা বলে ঋণ নিয়েছিলেন তা না করে এস আলম তার বিভিন্ন ব্যবসায় ঋণ পরিশোধও করেছেন। এর মাধ্যমে তারা মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ করেছেন।
এর আগে গত ২১ আগস্ট এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম ওরফে এস আলমের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে দুদক। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ইসলামী ব্যাংকে ব্যাপক ঋণ জালিয়াতির ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। নিয়ম না মেনে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকটির চট্টগ্রামের তিন শাখা থেকে ৩ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। দুদকে এ অভিযোগ জমা হওয়ার পর কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দুদকের উপ-পরিচালক ইয়াসির আরাফাতকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি দল গঠন করে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির অনুসন্ধান গতি পায়। এরপর গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ব্যাংকটির অর্ধশতাধিক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।
সম্পাদক ও প্রকাশক: জোনায়েদ মানসুর, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৫৬ পুরানা পল্টন, ঢাকা -১০০০। রেজিস্টার্ড : ২৯২ ভূইয়া পাড়া প্রধান সড়ক, খিলগাঁও, ঢাকা- ১২১৯। সম্পাদকীয়: ০১৭৮৯৪২১৪৪৪, বার্তাকক্ষ : ০১৯১৩৫৫৫৩৭১। ই-মেইল: inextpr@gmail.com , (বিজ্ঞাপন), newsuddokta@gmail.com (বার্তাকক্ষ)