480
ঢাকাবৃহস্পতিবার , ২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. অনুসন্ধানী ও বিশেষ প্রতিবেদন
  2. অপরাধ-আইন ও আদালত
  3. অর্থ-বাণিজ্য-শিল্প
  4. অর্থ-বাণিজ্য-শিল্প-ব্যাংক-বীমা-নন ব্যাংক
  5. আইটি, টেলিকম ও ই-কমার্স
  6. আবাসন-ভূমি-রাজউক-রিহ্যাব
  7. উদ্যোক্তা-জীবনী
  8. করপোরেট ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
  9. কৃষি, খাদ্য ও পরিবেশ
  10. গণমাধ্যম
  11. গৃহায়ন ও গণপূর্ত
  12. জনশক্তি ও পর্যটন
  13. জনসংযোগ-পদোন্নতি ও সম্মাননা
  14. জাতীয়
  15. দুর্ঘটনা-শোক-দুর্যোগ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ডুবতে বসেছে যমুনা ব্যাংক

https://www.uddoktabangladesh.com/wp-content/uploads/2024/03/aaaaaa.jpg
বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা
নভেম্বর ২১, ২০২৪ ২:১৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

*যোগ্যতায় না থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের এমডি নিয়োগ

ডুবতে বসেছে যমুনা ব্যাংক। ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় পরিচালকদের হস্তক্ষেপ, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের হস্তক্ষেপে কর্মীদের ছাঁটাই, চাকরিচ্যুত, দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাটে স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠেছে বেসরকারি যমুনা ব্যাংক লিমিটেডে। সম্প্রতি যোগ্যতায় না থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের এমডি নিয়োগ  বিষয়টি আরও গুরুত্বর অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ অমান্য করে ব্যাংকটি ঋণ প্রস্তাব, অনুমোদন ও বিতরণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতি-অনিয়ম করে কালো টাকার পাহাড় গড়ছেন বর্তমান এমডি মির্জা ইলিয়াছ্ উদ্দিন আহমেদ। এদিকে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর পরিচালকদের বেআইনি ও অনৈতিক চাপে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ব্যাংকিং খাতের সার্বিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা। পরিচালকদের বেপরোয়া চাপে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি, অনিয়মের পরিমাণ বেড়েই চলছে। এর ফলে বাড়ছে লোকসানি শাখা, দীর্ঘ হচ্ছে খেলাপি ঋণের তালিকা, মানা হচ্ছে না এডিআর। রেমিট্যান্স আহরণে দুর্বল, সিএসআরের টাকা ব্যয় হচ্ছে অন্য খাতে।

জানা গেছে, শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হয়েছেন মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদ। ‘অযোগ্য’ এমডিকে বিপুল অঙ্কের বেতন দিচ্ছে ব্যাংকটি। এরপরও আর্থিক অনিয়মে জড়িয়েছেন তিনি। তার ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক লেনদেন খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত দল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তার নিয়োগ নিয়ে অনিয়মে জড়িয়েছে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ। প্রথমত, তিনি বিনা যোগ্যতায় এমডি হওয়ার আবেদন করেছেন। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও তাকে এমডি নিয়োগের সুপারিশ করেছে ব্যাংকটির বোর্ড। আর নিজেদের নীতি পাশ কাটিয়ে বিশেষ বিবেচনায় অনাপত্তি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত, তাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এতে সাবেক গভর্নর ফজলে কবীরের বিশেষ নির্দেশনা ছিল। ফজলে কবীরের ছোট ভাই ফজলে কাইয়ূম এ বিষয়ে মধ্যস্থতা করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে তাকে নিয়োগ দেওয়া হলেও একে অনিয়ম হিসেবে সাব্যস্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কোনো ব্যাংকের এমডি হতে হলে তার শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়ে তৃতীয় বিভাগ থাকতে পারবে না বলে নীতিমালা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। যমুনা ব্যাংকের বর্তমান এমডি মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদ শিক্ষাজীবনে তৃতীয় বিভাগ রয়েছে। তা সত্ত্বেও নির্দেশনা অমান্য করে বিশেষ বিবেচনায় তাকে নতুন করে ১৩ লাখ টাকা বেতনে পাঁচ বছরের জন্য এমডি হিসেবে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া তার বেতনভাতা বাবদ পরিচালিত ব্যাংক হিসাবেও আর্থিক লেনদেনে অনিয়ম পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব অনিয়মের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে বলা হলেও কোনো প্রকার ব্যবস্থা নেয়নি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।

জানা যায়, মির্জা ইলিয়াছ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৮৫ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি প্রাইম ব্যাংক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে যমুনা ব্যাংকে এসএভিপি হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০১৩ সালে একই ব্যাংকে ডিএমডি ও ২০১৬ সালে এএমডি হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর ব্যাংকটির এমডি ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৯ সালে যখন তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়, সেই সময়েও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম না মেনেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কারণ ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ-সংক্রান্ত এক সার্কুলারে বলা হয়েছে, এমডি ও সিইও নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়েই তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি গ্রহণযোগ্য হবে না।

চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি এমডি নিয়োগের নতুন একটি নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নীতিমালায়ও একই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু মির্জা ইলিয়াছের তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ ডিগ্রি থাকার পরেও তাকে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর তার প্রথম দফার এমডি নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয়। দ্বিতীয় দফায় নিয়োগের জন্য ওই বছরের ১৯ এপ্রিল মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদ নাম সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন চাওয়া হয়। পরে তাকে পাঁচ বছরের জন্য এমডি হিসেবে পুনর্নিয়োগের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে দেখা যায়, ব্যাংকের পাশাপাশি নিজেদের তৈরি করা নির্দেশনাও নিজেরাই ভঙ্গ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদিকে তার পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে আর্থিক অনিয়ম পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল।

জানা গেছে, মির্জা ইলিয়াছ উদ্দিন আহমেদকে মোট ১৩ লাখ টাকা বেতনভাতায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা বেতনের নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু বিশেষ বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া একজন ‘অযোগ্য’ এমডিকে কেন এত বেশি বেতনভাতা দেওয়া হচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যমুনা ব্যাংকের এমডির বেতনভাতা পরিশোধের জন্য ব্যাংকটির দিলকুশা শাখায় একটি হিসাব পরিচালিত হয় (হিসাব নং-১১০২০০০০১৫৮৯৯)। এতে ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বেতনভাতা ও অপরাপর সুবিধার অর্থ হিসাবটিতে জমা হওয়ার পাশাপাশি নগদ এবং অন্য ব্যাংক থেকে অনলাইন ট্রান্সফারের মাধ্যমে প্রায় ৬৭ লাখ ৫৮ হাজার টাকা জমা হয়েছে। তবে এ অর্থের কোনো উৎস খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল। নগদ জমা ও অন্য ব্যাংক হতে অনলাইন ট্রান্সফারের ভাউচারগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানোর জন্য বলা হয়।

এ বিষয়ে জানতে যমুনা ব্যাংকের এমডি মির্জা ইলিয়াছকে একাধিকবার ফোন করা হয়। একপর্যায়ে তিনি ফোন রিসিভ করলেও সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কেটে দেন। পরবর্তী সময়ে তাকে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হলেও তিনি উত্তর দেননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অনেক সময় বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন দিক বিবেচনা নিয়ে অনাপত্তি দিয়ে থাকে। সেটা ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১’-এর ৪৫ ধারার ক্ষমতাবলে। তারা জানান, এসব বিষয়ে ব্যাংকের স্বার্থের চেয়ে রাজনৈতিক প্রভাব মুখ্য থাকে। নাম প্রকাশ না করে যমুনা ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবীরের ভাইয়ের মধ্যস্থতায় ব্যাংকের একজন পরিচালকের পছন্দে তাকে নিয়োগ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন।’

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজেদের নিয়মের পরিপন্থি কোনো বিষয়ে অনাপত্তি না দেওয়ার বিষয়ে মতামত দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ম করেছে। আবার তারাই যদি সেই নিয়মপরিপন্থ বিষয়ে অনাপত্তি দেয়, তাহলে বিষয়টি দৃষ্টিকটু। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এমডি ইলিয়াছের পুনর্নিয়োগের আগে ব্যাংকের খারাপ অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যর্থতা সত্ত্বেও তাকে বিশেষ বিবেচনায় পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা পরিদর্শক দলের দৃষ্টিতে স্পষ্ট অনিয়ম হিসেবে ধরা পড়ছে। কারণ এক্ষেত্রে ব্যাংকের স্বার্থের পরিপন্থি কাজ হয়েছে।

প্রতিবেদন বলছে, বর্তমান এমডির আমলে যমুনা ব্যাংক খেলাপি ঋণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের তুলনায় খেলাপি ঋণ ৪৪১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা থেকে বেড়ে সর্বশেষ গত জুন মাসে ৯৬০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০ কোটি টাকার খেলাপিযোগ্য ঋণকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে নিয়মিত করার শর্তে অশ্রেণিকৃত রাখা হয়। তবে এ সময়ের মধ্যে ঋণটি আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় নতুনভাবে ১৮৮ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল এসব অনিয়ম সংশোধন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘সাধারণত এমডি নিয়োগের বিষয়টি পর্ষদ কর্তৃক সুপারিশ করা হয়। এক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছিল। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তৎকালীন গভর্নর তা অনুমোদন দিয়েছিলেন।’ নিজস্ব নীতির পরিপন্থি সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গভর্নর তার বিশেষ ক্ষমতায় এটি করেছেন। যেহেতু গভর্নরের এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে, তাই বিয়টিকে অনিয়ম বলার সুযোগ নেই।’