অধ্যক্ষের দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ বারবার প্রমাণিত হওয়ার পরেও অদৃশ্য শক্তির বলয়ে তৎকালীন স্থানীয় এমপির আস্হাভাজন হওয়ার সুবাদে স্বপদে বহাল থেকেছেন। কলেজের পুরো কার্যক্রমে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগসহ নানা অভিযোগ রয়েছে সরকারি হোসেন আলী কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। সরকার পতনের পর তার গদি নড়ে গেছে বুঝতে পেরেই কর্মস্থল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে এই অধ্যক্ষে বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করেছেন কলেজের সঙ্গে যোগাযোগ।
কলেজ সূত্রে জানা যায়, সরকারি হোসেন আলী কলেজটি ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে গত ৮ আগষ্ট ২০১৮ সালে কলেজটি জাতীকরণ করা হয়। ২০১০ সালে বীরেশ্বর চক্রবর্তী অনিয়মের মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে রাতের আঁধারে ২০১৩ সালে অবৈধভাবে কমিটি গঠন করেন। কলেজের রশিদ না কেটেই অর্থ আদায়, পরিক্ষার ফি সহ যাবতীয় সকল টাকার লেনদেনে আর্থিক অনিয়ম করেন তিনি। কলেজ অডিট কমিটির স্বাক্ষর ছাড়াই তিনি সকল কর্মকান্ড চালিয়ে যান নিজের মত করে। কলেজের অন্য শিক্ষকদের তিনি বিভিন্ন সময় হুমকি ধামকি দিয়ে এসেছেন বলেও অভিযোগ করেন কলেজের কয়েকজন শিক্ষক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজের এক শিক্ষক বলেন, তিনি কলেজে না এসে বাড়িতে থেকেই কলেজের কার্যক্রম পরিচালনা করেতেন বেশিরভাগ সময়। সপ্তাহে দুই একদিন অল্প সময়ের জন্য কলেজে তার উপস্থিত থাকতেন। আর্থিক অনিয়মের পাশাপাশি দায়িত্বে অবহেলা, প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব এবং দুর্নীতির কারণে কলেজের সার্বিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।
জানা যায়, কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে উপরোক্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে তৎকালীন বেলাব উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুলতানা রাজিয়ার নির্দেশে তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়। কলেজটি সরকারিকরণের আদেশ জারির পর সভাপতি হিসেবে পর্যায়ক্রমে তৎকালীন বেলাব উপজেলা নির্বাহী অফিসার উম্মে হাবিবা ২০১৯ সালে, শামীমা শারমিন ২০২১ সালে ও মো. আক্তার হোসেন শাহিন ২০২২ সালে বিভিন্ন সময়ে অধ্যক্ষের দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত সাপেক্ষে সত্যতা পান এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সুপারিশ পত্র পাঠান। কিন্তু অধ্যক্ষের পিছনে কোনো এক অদৃশ্য শক্তি কাজ করায় এত দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও অর্থ আত্মসাৎ প্রমাণিত হওয়ার পরেও স্বকর্মস্থলে, স্বপদে বহাল রয়েছেন।
স্থানীয় এমপির ছত্রছায়ায় তিনি কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে কলেজ পরিচালনা করতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কলেজের রেজুলেশন খাতা, ভর্তি সংক্রান্ত তথ্য এবং কলেজ পরিচালনার কোনো কিছু কাউকে বুঝিয়ে না দিয়ে যাওয়ায় কলেজের কার্যক্রম পরিচালনায় বিঘ্নতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানান বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।
সরেজমিনে কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৮ সালে অডিট কমিটির মাধ্যমে ১১ লক্ষ ৫৭ হাজার ৬৭৯ টাকা আর্থিক অনিয়মসহ উপরোক্ত সকল অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। পরে অধ্যক্ষ বীরেশ্বর চক্রবর্তীর অনিয়মের বিবরণ উল্লেখ করে ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগপত্র প্রেরণ করা হয়। ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভায় শিক্ষক প্রতিনিধিগণ প্রতিষ্ঠানের আত্মসাৎকৃত অর্থ অতি দ্রুত কলেজ তহবিলে জমা দেওয়ার জন্য অধ্যক্ষকে বললে তিনি অর্থ আত্মসাতের কথা স্বীকারপূর্বক টাকা দ্রুত কলেজ তহবিলে জমা দেবেন বলে আশ্বাস্ত করেন।
পরে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে ৩ লক্ষ টাকা কলেজ ফান্ডে দিলেও বাকি ৮ লক্ষ ৫৭ হাজার ৬৭৯ টাকা আর জমা দেননি। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরবর্তী নির্দেশনা না পেয়ে, তৎকালীন বেলাব উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সরকারি হোসেন আলী কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি শামীমা শারমিনের হস্তক্ষেপে, কলেজ পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডিসেম্বর ২০২০ হতে অধ্যক্ষ বীরেশ্বর চক্রবর্তীর বেতন স্থগিত রাখার জন্য সোনালী ব্যাংক বেলাব শাখার ব্যবস্থাপককে অবহিত করা হয়। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ সদ্য জাতীয়করণকৃত কলেজটিকে স্বাভাবিকভাবে পরিচালনার বৃহত্তর স্বার্থে বর্তমান অধ্যক্ষর স্থলে কলেজের যোগ্য শিক্ষককে ডিডিওশিপ বা অ্যাকাডেমির দায়িত্ব প্রদানের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব বরাবর ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আবেদন করা হয়।
কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের কলেজটি একটি ঐতিহ্যবাহী কলেজ। এটার অনেক সুনাম রয়েছে। কিন্তু বীরেশ্বর চক্রবর্তী অবৈধভাবে নিয়োগের মাধ্যমে অধ্যক্ষ হওয়ার পর থেকেই কলেজের পতন শুরু হয়। তিনি কলেজে নিয়মিত আসতেন না, আসলেও দুপুর দুইটার পর আসতেন কিছুক্ষণ পর চলে যেতেন। তিনি কলেজের সকল সিদ্ধান্ত এককভাবে নিতেন। ওনার স্বেচ্ছাচারিতার কারণে কলেজের ফলাফল খারাপ হতে থাকে।
তিনি আরও বলেন, এরফলে কলেজের শিক্ষার্থী সংখ্যাও কমে যায়। তিনি শিক্ষদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করতেন। কলেজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আমরা চাই দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষকে অব্যহতি দিয়ে নতুন অধ্যক্ষের মাধ্যমে কলেজের ঐতিহ্য ফিরে আসুক।
কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক শফিকুর রহমান বলেন, ‘বীরেশ্বর চক্রবর্তী কলেজের জুনিয়র শিক্ষক হয়েও ক্ষমতা প্রদর্শন করে অবৈধভাবে অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েছেন। স্বৈরাচারী কায়দায় কলেজ পরিচালনা করতেন। কলেজে নামমাত্র কমিটি থাকলেও কোন মিটিং না করেই সকল সিদ্ধান্ত নিতেন। ওনি কলেজের টাকা আত্বসাৎ করে তার কিছু টাকা ফেরতও দিয়েছেন। শিক্ষক-কর্মচারীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে একাধিকবার তদন্ত করে তার দোষ প্রমাণ হলেও তার বিরুদ্ধে অদৃশ্য কারণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যার কারণে তিনি আরও বেপরোয়াভাবে দুর্নীতি ও ক্ষমতা দেখিয়ে কলেজ পরিচালনা করেছেন। এই দুর্নীর্তিবাজ অধ্যক্ষকে অবিলম্বে সরিয়ে নতুন অধ্যক্ষ নিয়োগের মাধ্যমে কলেজের স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছি।’
কলেজের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. জিয়াউর রহমান বলেন, ‘কলেজের উদ্ধুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমি অ্যাকাডেমিক কাজ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেও কলেজের কোন আর্থিক ক্ষমতা পাইনি। যার কারণে আমি দৈনন্দিন খরচ, পরীক্ষা পরিচালনাসহ কলেজ পরিচালনায় নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি।’
জিয়াউর রহমান আরও বলেন, ‘অধ্যক্ষ পলাতক থাকায় অফিসের আলমারি তালাবদ্ধ, সকল জরুরি কাগজপত্র ও কলেজের পাসওয়ার্ড ওনার কাছে রয়েছে। যার কারণে কলেজের কোন জরুরি কাজ করা যাচ্ছে না। পাসওয়ার্ড স্থানীয় একটা কম্পিউটারের দোকানে দেওয়া রয়েছে, সেখান থেকে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। যার কারণে আমরা ও ছাত্রছাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। অবিলম্বে দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষের বিচারের দাবি জানাচ্ছি, পাশাপাশি কলেজ পরিচালনার স্বার্থে নতুন অধ্যক্ষ নিয়োগ বা আমাকে আর্থিক ক্ষমতা প্রদানের আহ্বান জানাচ্ছি।’
কলেজের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে পলাতক অধ্যক্ষ বীরেশ্বর চক্রবর্তী বলেন, তিনি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মাউশির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছেন। তিনি কোন অবৈধ পন্থা অবলম্বন করেন নাই। কলেজের ক্যাশিয়ার না থাকায় তিনি এক বছর হিসাবকার্য দেখভাল করেছি। হিসাবে অদক্ষতার কারণে কিছু ভুল হয়েছে কিন্তু তিনি কোনও টাকা সরিয়ে নেননি। আর কলেজে কোন কম্পিউটার না থাকায় তিনি দোকান থেকে কাজ করিয়েছেন, কিন্তু পাসওয়ার্ড কাউকে সরবরাহ করেন নাই।
বীরেশ্বর চক্রবর্তী আরও বলেন, যদি দুর্নীতি প্রমাণিত হতো, আমি অধ্যক্ষ থাকতে পারতাম না, আমাকে অপসারণ করা হতো কিন্তু কিছুই করা হয়নি। শুধু তৎকালীন ইউএনও এর সঙ্গে ভুল বোঝাবোঝির কারণে বেতনের ব্যাংক হিসাব স্টপ পেমেন্টে করে দিছেন। ফলে নতুন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে বেতন-ভাতা নিচ্ছি। বর্তমানে মেডিকেল ছুটিতে আছি বলেও জানান তিনি।
বর্তমান বেলাব উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সরকারি হোসেন আলী কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মো. আব্দুল করিম বলেন, ‘কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগ, বদলি, বরখাস্ত সকল সিদ্ধান্ত মাউশি নিয়ে থাকেন। কলেজের অধ্যক্ষ দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকায় কলেজের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অধ্যক্ষ প্রয়োজন মর্মে মাউশি বরাবর আবেদন করা হয়েছে। এখন কী কারণে তারা অধ্যক্ষ দিচ্ছেন না, আমার জানা নাই। সেই সঙ্গে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়মসহ বিভিন্ন অভিযোগ তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
নরসিংদীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) ফারজানা আলম বলেন, ‘আমরা ইচ্ছে করলেই হঠাৎ কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। সরকারি হোসেন আলী কলেজের পরিবেশ ও পরিস্থিতির সার্বিক প্রতিবেদন মাউশি এর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছে পরবর্তী নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’