পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মো. মোজাম্মেল হক নারায়ণগঞ্জের পূর্বাচলের ৩ নম্বর সেক্টরের পাশে ‘আনন্দ পুলিশ পরিবার বহুমুখী সমবায় সমিতির’নামে একটি আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছেন। প্রায় তিন হাজার বিঘা জমি ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করা হচ্ছে। কয়েকটি প্লটে দাঁড়িয়ে গেছে বহুতল ভবনও। প্রকল্পটির বর্তমান বিক্রয়যোগ্য সম্পদের পরিমাণ প্রায় ছয় হাজার ৬৫০ কোটি টাকা।
তবে পুলিশ সদর দপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় খোঁজ নিয়ে এই ধরনের কোনো সমবায় সমিতির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধান বলছে, পুলিশ কর্মকর্তা মোজাম্মেল হকই এই বিপুল সম্পদের মালিক। মূলত পুলিশের নাম ভাঙিয়ে সাধারণ মানুষের জমি দখল করে তিনি এই বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। আইনের মারপ্যাঁচ এড়াতে কৌশলে এই বিপুল সম্পদের মালিকানা দিয়েছেন স্ত্রীর নামে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আবাসন প্রকল্পের জমিতে মিশে আছে অনেক নির্যাতিত মানুষের চোখের জল। বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কমে নামমাত্র মূল্যে জমির মালিকানা লিখে নিয়েছেন মোজাম্মেল। জমি কবজা করতে কাউকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনও করেছেন। এমনকি হুমকি দিয়ে জবরদস্তির মাধ্যমে কোনো মূল্য ছাড়াই জমি লিখে নিয়েছেন, এমন বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব কাজে তাঁকে সহায়তা করছে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র।
১৭তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ১৯৯৭ সালে গাজী মোজাম্মেল পুলিশের সহকারী কমিশনার পদে চাকরিজীবন শুরু করেন। চাকুরী জীবনে তিনি ও তাঁর স্ত্রী বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। স্ত্রীর নামে পুলিশের শীর্ষ এই কর্মকর্তা দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তুলেছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার বিঘা জমি। নারায়ণগঞ্জে ‘আনন্দ পুলিশ পরিবার বহুমুখী সমবায় সমিতির’পাশে প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে রয়েছে বাগানবাড়ি; যার বর্তমান মূল্য প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা।
একটি জাতীয় দৈনিকের সূত্র অনুযায়ি, নারায়ণগঞ্জের দাউদপুর ইউনিয়নের ওলপ গ্রামে ৩০ বিঘা জমি কিনেছেন, যার বর্তমান বাজারদর প্রায় ৩০ কোটি টাকা। সদর ইউনিয়নের গুতিয়াবো মৌজায় সরকারি সম্পত্তি দখল করে ৮৩ শতাংশ জমিতে বাড়ি নির্মাণ করছেন। বর্তমানে আরো জমি কেনার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সুনামগঞ্জের হাসাউড়ায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ১০০ বিঘা জমি রয়েছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার বড়কান্দা ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে স্ত্রীর নামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। সেখানে আছে ‘মেঘনা রিসোর্ট’ নামে একটি বাগানবাড়ি ও বিশাল মাছের খামার। ২০০ বিঘা আয়তনের এই খামারটির বাজারদর অন্তত ২০ কোটি টাকা। এখানে অবকাঠামোগত ও মৎস্য প্রকল্প উন্নয়নে ব্যয় করেছেন কয়েক কোটি টাকা। নগদ টাকায় কেনার পাশাপাশি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন মানুষের সম্পদ দখলও করেন মোজাম্মেল। এমনকি মেঘনা নদীও গিলে খাচ্ছেন তিনি।
স্ত্রীর নামে আবাসন কোম্পানি্র; আবাসন প্রকল্পের জমি কেনাবেচায় সবখানে প্রকাশ্যে পর্দার সামনে থাকেন অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক। প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নথিপত্রে সইও করেন তিনি। এমনকি প্রকল্পের কর্মকর্তারাও নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন, এই প্রকল্পের মালিক মোজাম্মেল। কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচ এড়াতে কৌশলে স্ত্রীর নামে খুলে দিয়েছেন একটি কোম্পানি। আর স্থানীয়ভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন আবাসন প্রকল্পের জমিগুলোর মালিক তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন কোম্পানি ‘আনন্দ প্রপার্টিজ লিমিটেড’। ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে প্রকল্পের কিছু জমির মালিকানাও দেখানো হয়েছে এই কোম্পানির নামে।
নথিপত্রে দেখা যায়, মোজাম্মেলের স্ত্রী ফারজানা মোজাম্মেল ‘আনন্দ প্রপার্টিজ লিমিটেডের’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই কোম্পানির ১৫ হাজার শেয়ারের মধ্যে সাড়ে ১৩ হাজারের মালিকানা তাঁর, যা মোট শেয়ারের ৯০ শতাংশ। বাকি দেড় হাজার শেয়ারের মালিক হলেন খাইরুল আলম ও শহিদুল ইসলাম লিটন নামের দুই ব্যক্তি। এই দুজনকে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় দেখালেও মূলত তাঁরা প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারী। কোম্পানিটি নিবন্ধিত হয় ২০১৩ সালের ১৬ জুন। নম্বর সি ১০৯৭১৬। নিবন্ধিত মূলধন তিন কোটি টাকা।
নথিপত্রে আরও দেখা গেছে, ২০১৬ সালের নভেম্বরে আনন্দ প্রপার্টিজ ৭৭২ শতাংশ বা ৬৮.৬১ বিঘা জমি নিজেদের মালিকানায় আছে বলে ঘোষণা দেয়। জায়গাগুলো মোগলান, গুতিয়াব, পিতলগঞ্জ প্রভৃতি মৌজায় দেখানো হয়েছে। রূপগঞ্জে প্রতিবিঘা জমির সর্বনিম্ন বাজারমূল্য দেড় কোটি টাকা ধরে হিসাব করলে ফারজানা মোজাম্মেলের নামে থাকা আনন্দ প্রপার্টিজের বর্তমান বাজারমূল্য শতকোটি টাকার বেশি। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই প্রপার্টিজের দখলে অন্তত তিন হাজার বিঘা জমি রয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ছয় হাজার ৬৫০ কোটি টাকা।
এদিকে, আবাসন প্রকল্পটির নাম নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট এবং রূপগঞ্জের ভূমি অফিসে কোম্পানির দেওয়া ব্লুপ্রিন্টে ‘আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটি’ উল্লেখ রয়েছে। অথচ প্রকল্পের সাইনবোর্ডে লেখা ‘আনন্দ হাউজিং সোসাইটি’। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এটির সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর কোনো অফিশিয়াল সংশ্লিষ্টতা নেই। হাউজিং কোম্পানিতে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা মালিকানায় আছেন বলে প্রচার করা হলেও এটি মূলত ডিআইজি মোজাম্মেল পরিচালনা করেন। আর সামনে রাখেন তাঁর স্ত্রী ফারজানা মোজাম্মেলকে।
স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে প্রায় তিন হাজার বিঘা জমি কবজা করে ফেললেও ভূমি অফিসের নথি বলছে, প্রকল্পের খারিজ করা জমির পরিমাণ মাত্র ৪০০ বিঘা। আবার এই ৪০০ বিঘা জমি নিয়েও রয়েছে মামলা। প্রায় আড়াই শ ভুক্তভোগী এই জমির মালিকানা দাবি করে মামলা করেছেন। হাউজিংয়ের দখলে থাকা বাকি জায়গার মালিকানা নিয়ে তো বিরোধের অন্ত নেই।
নামসর্বস্ব আনন্দ পুলিশ হাউজিং ২০২৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত আনন্দ প্রপার্টিজের একটি সিসটার কনসার্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল। কিন্তু গত ৩১ মার্চ দৈনিক কালের কণ্ঠে পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিপুল পরিমাণ সম্পদের সংবাদ প্রকাশের পর তড়িঘড়ি করে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে রেজিস্ট্রার অব জয়েন স্টকে এটির আলাদা কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন করা হয়। সেখানে মোজাম্মেল নিজের স্ত্রীকে বাদ দিয়ে এটির নিবন্ধন করান।
স্ত্রীর নামে আরো সম্পদ: অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল হকের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার বড়কান্দা ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে। সেখানেও স্ত্রী ফারজানা মোজাম্মেলের নামে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। এর মধ্যে ২০০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল বাগানবাড়ি ও মৎস্য খামার। নাম দিয়েছেন ‘মেঘনা রিসোর্ট’। শুধু রিসোর্টই নয়, হরিপুরে স্ত্রী ফারাজানার নামে চারতলা ভবনের সুরম্য অট্টালিকা গড়ে তুলেছেন মোজাম্মেল। এছাড়াও, মোজাম্মেল ও তাঁর স্ত্রীর নামে আরও অনেক সম্পদ রয়েছে। সূত্র: কালের কণ্ঠ