# পাঁচ মেয়াদে ১৫ বছর ধরে হোমিও বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ দখল
#৮০-এর দশকে হোমিওপ্যাথী মেডিকেল কলেজে ছিলেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচার
পনের বছরের ব্যবধানে চতূর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডা. দিলীপ কুমার রায়। রাজনীতির জাদুর ছোঁয়ায় তিনি হোমিও মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক থেকে হয়েছেন বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথী বোর্ডের চেয়ারম্যানও। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারে সিদ্ধহস্ত দিলীপ কুমার রায় টানা পাঁচ মেয়াদে ১৫ বছর ধরে হোমিও বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ দখলে রেখেও গড়েছেন রেকর্ড।
বোর্ডে দুর্নীতি হালাল করতে নীতিকে পাল্টে অনিয়মকেও তার ব্যক্তিগত নিয়মে পরিণত করেছেন। চা-পোষা হোমিও চিকিৎসক সেই দিলীপ কুমার এখন রাজনীতিতে বড় নেতা, স্বর্ণ, ডায়মন্ড, ইটভাটা, খাদ্য ও ওষুধের এক্সেসরিজের ব্যবসায়ীও।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী এলাকার ধোপা পরিবারের সন্তান দিলীপ কুমার এখন প্রতিষ্ঠিত এক স্বর্ণ ও হিরা ব্যবসায়ীর নাম। কারখানা গড়ে ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন খাদ্য, ওষুধ ও ওষুধের এক্সেসরিজ খাতেও। অথচ ৮০-এর দশকে হোমিওপ্যাথী মেডিকেল কলেজে ছিলেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। পাশপাপশি হাঁটতেন রাজনৈতিক এক নেতার অনুসারি হয়ে। এরপর দিলীপ কুমারের উত্থান যত না আকাশচুম্বী ততই রহস্যে ঘেরা।
রাজধানীর জয়কালি মন্দির এলাকায় বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে হোমিওপ্যাথিতে তিন বছরের ডিপ্লোমা করেই ডা. বনে যান দিলীপ কুমার। কলেজটিতে নথিভুক্ত হন আউটডোর চিকিৎসক ও পিডি হিসেবে।
কলেজটির তৎকালীন ভিপি, জিএস ও হোমিও খাতের পরিচিতজনরা বলছেন, ৮২-তে কেয়ারটেকার হিসেবে কলেজটিতে জয়েন করেন দিলীপ। ৮৩-তে জয়েন করেন পিডিতে। তারপরে একসময় তিনি বনে যান আরএমও। এরকিছুদিন পরই আবার হয়ে যান হোমিপ্যাথি বোর্ডের চেয়ারম্যান। হোমিওপ্যাথি সমাজের অনেকেই এ নিয়ে ক্ষুব্দ। তারা বলছেন, তিনি তার রাজনৈতিক পদ-পদবী ব্যবহার করেই হোমিওপ্যাথি বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছেন।
সূত্র বলছে, কলেজটিতে ইনডোর চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকলেও রাজনৈতিক প্রভাবেই বনে যান হোমিও জগতের একমাত্র আবাসিক চিকিৎসক আরএমও। এরপর ২০০৯ সালে দিলীপ কুমার হোমিও চিকিৎসক থেকে হয়ে যান হোমিও বোর্ডেরই চেয়ারম্যান। এরপর আর কে সরায় তাকে। তিন বছর মেয়াদী হোমিওপ্যাথি বোর্ডে গুণে গুণে পাঁচ দফায় ১৫ বছর থেকে যান চেয়ারম্যান পদে। অর্থের উত্থানও এখান থেকেই শুরু।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বোর্ডের বড় বড় নিয়োগসহ বিভিন্ন কলেজের নিয়োগগুলোর প্রত্যেকটি থেকেই বড় অঙ্কের টাকা নিয়েছিলেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফরিদপুরের বোয়ালমারী এলাকার একাধিক স্থানীয়রা জানান, দিলীপের বাবা ছিলেন ধোপা। ওনার দাদাও ধোপা ছিলেন। অথচ এখন তারা শুনছেন, তার স্বর্ণের দোকান রয়েছে, বড় বড় ব্যবসা রয়েছে। আবার ইটভাটা এবং ভারতে চার-পাঁচটা বাড়ি করেছে।
স্থানীয়দের প্রশ্ন, দিলীপ এতো টাকার মালিক হলো কিভাবে? :
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে বোর্ড চেয়ারম্যান হলেই মূলত শুণ্য থেকে ফুলেফেঁপে বাড়তে থাকে দিলীপ কুমারের সম্পদ। সম্পদ গড়ার ধারাবাহিকতায় রাজধানীর বায়তুল মোকাররমে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের দুটি দোকান কিনে প্রতিষ্ঠা করেছেন ব্যয়বহুল বিলাসী ব্যবসা গ্রামীণ জুয়েলার্স। একই মার্কেটে গড়েছেন অবিশ্বাস্য ডায়মন্ডের বিশাল শো-রুম। এছাড়াও বসুন্ধরা সিটি শপিং মল ও নিউমার্কেটেও প্রায় কোটি টাকা মুল্যের দুটি দোকান কিনে গ্রামীণ জুয়েলার্স ও ডায়মন্ড ব্যবসার প্রসার ঘটান। এসব দোকানের প্রতিটিতেই রয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকার বেশি স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের মজুদ।
রাজধানীর মাতুয়াইলে দিলীপ রায় প্রথম ব্যবসা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামীণ ফুডের বিশাল কারখানা। পরে মতিঝিল, বায়তুল মোকাররম ও সদরঘাটসহ রাজধানীতে চারটি দোকানে শুরু করেন গ্রামীণ ফুডের শো-রুম। চা-পোষা হোমিও ডাক্তার থেকে দিলীপ কুমার এখন ইটভাটা ব্যবসায়ীও। ফরিদপুর বোয়ালমারীর সাতাশি এলাকায় রয়েছে তার গোল্ডেন ব্রিকস নামে একটি অটো ব্রিকস কারখানা ও সাধারণ ইটভাটা।
সূত্র জানায়, ১৩ সেগুনবাগিচার রুপায়ন লোটাস টাওয়ারেও রয়েছে তার দুটি ফ্ল্যাট। শান্তিনগরে স্কাইভিউ পার্ক সিটি টাওয়ারে মেয়ের নামে কেনেন আরও একটি ফ্ল্যাট। শুধু তাই নয়- পূর্বাচলে কয়েক কোটি টাকায় কেনেন আরও পাঁচ কাঠার প্লট। রাজধানীর জয়কালি মন্দির এলাকায় দিলীপ কুমার রায় গড়ে তোলেন রায় হোমিপ্যাথি পাইকারি ব্যবসা। ফরিদপুরে কাজী হারুন শপিং কমপ্লেক্সে রয়েছে আরও দুটি ফ্ল্যাট। এছাড়া নামে বেনামে রয়েছে বেশকটি বিলাসবহুল গাড়ি। সম্পদ গড়ার ক্ষেত্রে এতেই ক্ষান্ত নন দিলীপ কুমার। নিজের নামে বোয়ালমারীতে গড়েছেন ডা. দিলীপ কুমার রায় হোমিও মেডিকেল কলেজ। বোর্ড চেয়ারম্যান পদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ডা. দিলীপ তার কলেজের নামে চারদফায় নিয়েছেন এককোটি টাকারও বেশি অনুদান। অথচ সারাদেশেই হোমিও কলেজগুলো অর্থাভাবে জর্জরিত। দিলীপ রায় মানিকগঞ্জে গড়েছেন ওষুধ এক্সেসরিজের কারখানা। এছাড়া ফরিদপুর বোয়ালমারীর ধুল পুকুরিয়া এলাকায় কিনেছেন কয়েক’শ একর সম্পত্তি। ফরিদপুরের নিজ গ্রামেও গড়েছেন বিলাসবহূল বাড়ি। কথিত আছে, দিলীপ রায় কানাডা ও পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতার মধ্যম গ্রামেও কিনেছেন বাড়ি।
জানা গেছে, হোমিওপ্যাথি বোর্ড ভেঙে হোমিও শিক্ষা ও চিকিৎসা কাউন্সিল গঠিত হলে ডা. দিলীপ রায় এখন তার নির্বাহী চেয়ারম্যান। যুগ আসে যুগ যায় কিন্তু হোমিও জগতে যেন দিলীপ যুগের ক্ষয় নেই।
অভিযোগ রয়েছে, হোমিও বোর্ডের ২৭টি নতুন কলেজের অনুমোদন দিয়ে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ ও বদলী বাণিজ্য সবকিছুরই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। আর এখান থেকেই শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে অর্থবিত্তের কুমির বনে গেছেন দিলীপ রায়। চতূর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে হোমিও ডাক্তার দিলীপ রায় শুধু হোমিও চেয়ারম্যানই নন, তিনি ছিলেন জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান মালিকদের সংগঠন বাজুসের সভাপতি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহ-সভাপতিও। একইসঙ্গে বায়তুল মোকাররম দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। সবদিকে সমানতালে আধিপত্য বিস্তারে পারদর্শী দিলীপ রায়ের এতসব বিত্তবৈভবের রসদ একমাত্র রাজনৈতিক প্রভাব।
এদিকে দলীয় নেতাকর্মীরাও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলছেন, নারী আর টাকার কাছে রাজনৈতিক নীতি বিসর্জন দেওয়া দিলীপের কাছে মামুলি বিষয়। ২০১০ সালে জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনের সময় জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা ডা. আতাহার আলীকে গ্রেপ্তার করে ওয়ারি থানা পুলিশ। অথচ ২৫ লাখ টাকার বিনিমিয়ে জামায়াতের সেই নেতাকেই হোমিওপ্যাথি বোর্ডের সদস্য করে দিলীপ। অন্যদিকে হোমিওপ্যাথি কলেজেরই কথিত শিক্ষক রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের স্ত্রীর সঙ্গেও পরকীয়ায় পরোক্ষ সুযোগ দেওয়ায় সিনিয়র একাধিক শিক্ষককে বাদ দিয়ে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকেই ভাইস প্রিন্সিপাল পদে দায়িত্ব দেয় দিলীপ। কলেজের একাধিক শিক্ষক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হিসেবে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া দিলীপ কুমারের বিষয়ে জানতে চেয়ে একই কমিটির সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তা বন্ধ থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে, শনিবার গুলিস্থানে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে দলের এমন নেতাদের বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে জানতে চাইলে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এমন নেতাদের একটি তালিকা করে দেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা সেই তালিকাটি দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দেব। সূত্র: দেশ টিভি
সম্পাদক ও প্রকাশক: জোনায়েদ মানসুর, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৫৬ পুরানা পল্টন, ঢাকা -১০০০। রেজিস্টার্ড : ২৯২ ভূইয়া পাড়া প্রধান সড়ক, খিলগাঁও, ঢাকা- ১২১৯। সম্পাদকীয়: ০১৭৮৯৪২১৪৪৪, বার্তাকক্ষ : ০১৯১৩৫৫৫৩৭১। ই-মেইল: inextpr@gmail.com , (বিজ্ঞাপন), newsuddokta@gmail.com (বার্তাকক্ষ)